করোনায় তাঁরা অভাবী আর সমস্যাজর্জর মানুষের পাশে থেকে ত্রাণ বিতরণ করছেন। দিচ্ছেন কম দামে সবজি। আরও সহায়তা তো আছেই। এ হলো ‘পাশে আছি’ নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগ। এর কান্ডারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুণ।
সংগঠনটির জন্ম মাস দেড়েক আগে। করোনার সংক্রমণে তখন লকডাউন শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দুজন শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসান আর রাফিউল মাহমুদ চৌধুরীর প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল নিজ নিজ এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষকে যথাসাধ্য সহায়তা করা। প্রথম দিন শেষে এ নিয়ে একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসও দেওয়া হয়। এতে ছিল সাধারণ মানুষকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাহায্য করার আকুল আবেদন। সেই আবেদনে সাড়া দেয় সারা বাংলাদেশ। এক রাতেই হাজার পাঁচেক শেয়ার পায় পোস্টটি। জন্ম নেয় ‘পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ’ নামের সংগঠন। গত দেড় মাসে পাঁচ হাজারের বেশি পরিবারকে সাহায্য করেছেন সংগঠনের সদস্যরা। এখন আর এটি শুধু দুই বন্ধুর স্বপ্ন নয়, সেখানে যোগ দিয়েছেন অর্থনীতি বিভাগের অন্য বন্ধুরাও। তাঁরা হলেন সাকিফ, আনিকা, জোয়া, অভীক, রিফাত, নিলয় প্রমুখ।
শুরুর কথা
প্রথম দিকে পাশে আছি ইনিশিয়েটিভের সদস্যরা চাল, ডাল, তেল, আলু আর সাবানের প্যাকেট বিতরণ করেন দুস্থ মানুষের মধ্যে। একটি পরিবারের অন্তত এক সপ্তাহের খাবার জোগান হতো এতে। শুরুটা ছিল ৫০ জন রিকশাচালক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালককে দিয়ে। প্রথম সপ্তাহেই সংখ্যাটা ৩০০ জন ছাড়ায়। দেশ-বিদেশের শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহায়তায় সংগঠনটি পৌঁছে যায় ঢাকাসহ দেশের প্রায় ১০টি জেলায়।
যেখানে সাহায্য নেই, সেখানে তাঁরা
গত দেড় মাসে পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ সাহায্য করেছে এমন সব জনগোষ্ঠীকে, সাধারণের সাহায্য যেখানে পৌঁছায় না। ঢাকা ও সাভারের তৃতীয় লিঙ্গ গোষ্ঠী পেয়েছে তাদের সহায়তা, একই সঙ্গে বেদেপল্লি ও যৌনপল্লির আয়হীন মানুষকে সাহায্য করেছে এ সংগঠন। সীমিত লোকবল থাকা সত্ত্বেও সারা দেশের শুভাকাঙ্ক্ষীদের সদিচ্ছায় তাঁরা সাহায্য করেছেন রংপুর, ভোলা, ময়মনসিংহ, সাভার, গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, কুড়িগ্রাম, পাবনাসহ বেশ কিছু জেলায়।
ময়মনসিংহের গারো সম্প্রদায় ও ভাসমান মান্তা সম্প্রদায়ের কাছেও পৌঁছে গেছেন তাঁরা। কয়েক শ পরিবারের কিছুদিনের খাদ্যের জোগাড় হয়েছে। সম্প্রতি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায় তাঁতশ্রমিকদের দুর্দশা দেখে সংগঠনটি তাঁদের পাশে দাঁড়ায়। খাবার দেওয়ার পাশাপাশি তাঁতের লুঙ্গি বিক্রির ব্যবস্থা করে, যার পুরো টাকাই যাবে এই তাঁতিদের কাছে। বাংলাদেশের মৃতপ্রায় তাঁতশিল্পকে যথাসম্ভব সহায়তা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর বস্তি, যেখানে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা প্রবল, নিয়মিত সেসব জায়গায় জীবাণুনাশক স্প্রে করেছেন তাঁরা।
নাগরিক সুরক্ষা বজায় রাখতে রিকশাচালকদের মধ্যে তাঁরা বিনা মূল্যে জীবাণুমুক্তকরণ স্প্রেয়ার বিতরণ করেছেন কিছুদিন আগেই। যেহেতু রিকশাই এখন চলাচলের জন্য মোটামুটি সবাই ব্যবহার করছেন, তাই রিকশা পরিষ্কার রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য সংগঠনটির এই উদ্যোগ।
অসহায় কৃষক পেলেন সবজির ন্যায্য দাম
সংগঠনটির কাছে খবর আসে, পঞ্চগড়ের কৃষকেরা অভাবে পড়ে নামমাত্র মূল্যে সবজি বিক্রি করছেন। ৫ টাকায় একটি লাউ, ২ টাকায় এক কেজি বেগুন, ৪ টাকায় একটি কুমড়া। কেনার কেউ নেই দেখে তাঁরা এত কম দামে সবজি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। খবর জেনে পাশে আছি ইনিশিয়েটিভের সদস্যরা তাঁদের থেকে প্রায় ৫ টন সবজি ন্যায্যমূল্যে কিনে ঢাকা শহরে বিতরণ করেন।
পবিত্র রমজান মাসে যখন ভোগ্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী, তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সবজি নিয়ে এসে ঢাকার ৫টি স্পটে ন্যায্যমূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করে সংগঠনটি। সেখান থেকে লব্ধ অর্থের পুরোটাই দুস্থ মানুষের সহায়তায় কাজে লাগানো হচ্ছে। যেখানে ঢাকার বাজারে কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়, সংগঠনের পক্ষ থেকে তা বিক্রি করা হয় ২০ টাকায়। ঢ্যাঁড়স, পটল, জালি কুমড়া, লাউ বিক্রি করা হয় মাত্র ১০ টাকায়। এতে ক্রয়মূল্য না উঠলেও, এই বিপদের সময় মানুষের পাশে থাকতে পারাটাই তারা বড় করে দেখা হচ্ছে।
পরিবহনশ্রমিকের পাশে ওঁরা
পরিবহনশ্রমিকদের অসহায়ত্বের কথা টিভি ও পত্রিকায় প্রচার হচ্ছিল কিছুদিন ধরে। পরিবহন যেহেতু বন্ধ, তাই এ খাতের চালক, সুপারভাইজার সবাই এখন বিপদে। কোনো জায়গা থেকে তেমন সহযোগিতাও পাচ্ছিলেন না তাঁরা। জাতীয় সড়ক পরিবহন মোটর শ্রমিক ফেডারেশনের পাঠানো তালিকা অনুযায়ী সংগঠনটি ২০০ খাবার প্যাকেট দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করেছে দুদিন আগেও।
এখন যেভাবে কাজ চলছে
সম্প্রতি তাঁরা জাকাতের অর্থ জোগাড় করে প্রান্তিক আয়ের এই জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করবার সিদ্ধান্ত নেন। জাকাত হিসেবে প্রতিবছর দুস্থ মানুষকে অর্থসাহায্য করা হয়ে থাকে। এবারের লকডাউনের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না দেখে তাঁরা এগিয়ে আসেন এই মহৎ কাজে।
তাঁরা কারা
পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক পাশে আছি ইনিশিয়েটিভের কর্মিবাহিনীর সঙ্গে। ওঁদের দলে আট বন্ধু। সঙ্গে হাজারো শুভাকাঙ্ক্ষী, যাঁরা শুধু মানুষের ভালো করার জন্যই যথাসাধ্য সহায়তা করে যাচ্ছেন। তাহমিদ আর রাফিউলের কথা আগেই বলেছি। ওঁদের বন্ধু সাকিফ আর আনিকাও করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পিপিই পরে খাবার দিয়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষদের। লকডাউনে সবার পক্ষে বাইরে বের হয়ে কাজ করা সম্ভব নয়, কিন্তু ঘরে বসে অনলাইনে যথাসম্ভব কাজ করে যাচ্ছেন অভীক, জোয়া, নিলয় ও রিফাত। একই বিভাগের, একই ব্যাচের সব বন্ধু মিলে অসাধারণ এক উদ্যোগ নিয়ে পেশাদারির সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন, বিষয়টি প্রশংসনীয়।
করোনার ঝুঁকি নিয়েও কাজ করে যাচ্ছেন, ভয় লাগে না?
এ প্রশ্নের জবাবে তাহমিদ বলেন, ‘আমরা শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই বের হওয়ার চেষ্টা করি। এর পরও যদি কিছু হয়ে যায়, এর জন্য তো আর মানবসেবা থেমে থাকতে পারে না। পিপিই কিট পরলে প্রচণ্ড গরম লাগে, বাসায় ফিরে ঘণ্টাখানেক গোসল করতে হয়, কিন্তু দিন শেষে খাবার হাতে ওই ছোট্ট শিশুটি বা জরাগ্রস্ত ক্লান্ত বৃদ্ধ মানুষটির মুখে হাসি দেখলে মনে হয়, আমাদের এই কষ্ট কিছুই না।’
অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তাঁরা জানালেন, এক লেগুনাচালক তাঁর ছোট মেয়ের জন্য গুঁড়া দুধ নিতে সেই ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসেন ‘পাশে আছি’র কার্যস্থলে। অর্থ আর খাদ্যাভাবে অনাহারে থাকা গারো সম্প্রদায়ের মানুষের খাবার পেয়ে উচ্ছ্বাস যেমন তাঁদের আন্দোলিত করে, তেমনি যৌনকর্মী বা তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করাও অনেক আনন্দের। সব মিলিয়ে কষ্ট-আনন্দ পাল্লায় চড়লে মানবসেবার, মানুষের ভালো করবার সুখটাই বেশি ভারী বোধ হয়।
পাশে আছি ইনিশিয়েটিভের এই চমৎকার উদ্যোগে সাড়া দিয়েছেন অনেকেই। তাঁদের ফেসবুক ইভেন্ট ‘১০০ টাকায় ২ বেলা’তে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে করেছেন সহায়তা। দেশ ও দেশের বাইরে প্রবাসীদের অনুদানে খাবার মিলেছে হাজারো নিম্ন আয়ের পরিবারের। ৫০ পরিবার দিয়ে শুরু করা এই উদ্যোগ আজ ৫ হাজার ছাড়িয়েছে, লক্ষ্য ১০ হাজার পরিবার বা তারও বেশি। সংগঠনটি এই মানুষগুলোর পাশে থাকতে চায়, যত দিন সম্ভব, যতটা সম্ভব।
একজন সদস্য বললেন, ‘আমাদের কাজ থেমে থাকবে না। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আমরা কাজ করে যাব। পাশে থাকব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। আর্থিক সহায়তা ফুরিয়ে না গেলে আমরাও ফুরিয়ে যাব না।’
সংগঠনটি আশা করছে, তারা লক্ষ্যে পৌঁছাবে। হাজার থেকে লাখো পরিবার সহায়তা পাবে তাদের।
পাশে আছি ইনিশিয়েটিভকে আর্থিক সাহায্যের ঠিকানা:
বিকাশ:
+8801707117066
+8801772032528
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট:
অ্যাকাউন্ট নম্বর: 1061440479332
অ্যাকাউন্ট নাম: তাহমিদ হাসান
ব্যাংক: ইস্টার্ণ ব্যাংক লিমিটেড, ধানমন্ডি শাখা।