আবদুর রহমানের বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। মিরপুরে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার নৈশ প্রহরী। ৩৫ বছরের চাকরি জীবনের বেশির ভাগ কাটিয়ে দিয়েছেন এখানে। মিরপুরে চিড়িয়াখানার পশুপাখির সঙ্গে নিত্য বসবাস। তিন যুগে আবদুর রহমান কখনো চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকতে দেখেননি। সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু প্রায় আড়াই মাস ধরে অলস দিন কাটছে তাঁর। ঈদের দিন হলে তো কথাই ছিল না। হাজারো দর্শনার্থীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হতো আবদুর রহমানকে। আজ সোমবার ঈদুল ফিতরের দিন চিড়িয়াখানার চিত্র পুরোই উল্টো। প্রধান ফটক বন্ধ। নেই কোনো হল্লা। সুনসান নীরবতা। করোনা পরিস্থিতি কেড়ে নিয়েছে চিড়িয়াখানার দর্শকভরা জমজমাট পরিবেশ।
চিড়িয়াখানায় ঢুকে দেখা গেল অন্য রকম নিস্তব্ধতা। পশুপাখিরা আছে যে যার মতো। দর্শক এলেই কী, আর না এলেই কী, ওদের কী আসে–যায? প্রবেশমুখের পাশে চিত্রা হরিণেরা বিশাল বেষ্টনীতে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে। নেই কোনো ডরভয়। বরং মনের আনন্দে ঘাস, লতাপাতা চিবোচ্ছে। নীরবতার মধ্যে হঠাৎ কোনো মানুষের সাড়া পেলে কিছু হরিণ মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখে। তারপর আবার আপন মনে খেতে শুরু করে। হরিণদের অন্য কয়েকটি দল আবার আলাদা হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে গাছের ছায়ায়।
হরিণের বেষ্টনীর কিছুটা দূরে বানরের খাঁচা। অন্য কোনো সময় হলে দর্শনার্থী দেখলে কিছুটা নিশ্চুপ হয়ে যেত। কিন্তু এখন অন্য রকম আচরণ ওদের। অপরিচিত কাউকে দেখলে খাঁচার কাছে চলে আসে বানরেরা। হয়তো বাদাম পাবে, এই আশায়। খানিকটা খেলা দেখাতে চায়। তবে বাদাম বা অন্য কোনো খাবার দেওয়ার দর্শক না থাকলেও আনন্দে ভাটা নেই। লাফঝাঁপে মজা করছে ওরা।
হরিণ–বানরদের মতো মহা আনন্দে দিন কাটাচ্ছে বাঘ, সিংহ, গন্ডার, জলহস্তী, হাতি, হায়েনা, গাধা, জিরাফ, কুমির, ময়ূর, জেব্রা, ঘোড়াসহ প্রায় পৌনে তিন হাজার প্রাণী।
প্রাণীরা আনন্দে মুখরিত হলেও আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানালেন বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার কিউরেটর নূরুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ঈদের দিন প্রায় এক লাখ দর্শনার্থী আসেন এখানে। ঈদের পরদিন থেকে সপ্তাহখানেক ভিড় লেগেই থাকে। কিন্তু করোনাভাইরাস সবকিছু ওলট–পালট করে দিয়েছে। গত মার্চের ২০ তারিখ থেকে এখানে দর্শনার্থী প্রবেশ নিষেধ। কবে খুলবে, সে ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে প্রাণীরা বেশ ভালো আছে। এত ভালো আগে কখনো দেখা যায়নি। ওদের মনে আতঙ্ক নেই। আশা করছি, নতুন প্রাণীও জন্ম নেবে।
আনন্দে মেতে থাকায় প্রাণীদের খাবারের চাহিদাও বেড়ে গেছে। চিড়িয়াখানার প্রাণী পুষ্টি শাখার কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, আগে দেখা যেত, দর্শনার্থী বেশি দেখলে ঠিকমতো প্রাণীগুলো খাবার খেত না। কিছু খাবার পড়েও থাকত। এখন খাবার পড়ে থাকে না। সব খাবার খেয়ে নিচ্ছে। খাবারের চাহিদাও বেড়ে গেছে।
দর্শনার্থী না থাকায় আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান চিড়িয়াখানার টিকিটের ইজারাদার প্রতিষ্ঠান শিখা ট্রেডার্সের কর্ণধার বিমল চন্দ্র মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘এক বছরের জন্য ১২ কোটি টাকায় টিকিট বিক্রির ইজারা নিয়েছি। রোজার ঈদে বড় আয় হয়ে থাকে। এবার শুধু ঈদ না, পয়লা বৈশাখে করোনার কারণে চিড়িয়াখানা বন্ধ ছিল। সামনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কবে, তা জানি না।’