এক বছর সাত মাস বয়সের জারা আক্তারের লাশ মৃত্যুর পাঁচ মাসের মাথায় কবর থেকে তোলা হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে শিশুটির লাশ রাজধানীর জুরাইন কবরস্থান থেকে তোলা হয়। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে।
কদমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল উদ্দিন মীর বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জারার মৃত্যু খুবই রহস্যজনক। আদালতের অনুমতি নিয়ে গত সপ্তাহে লাশ কবর তোলা হয়েছে। ময়নাতদন্ত হয়েছে। তবে আমরা জারার মা মৌসুমী আক্তারকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তদন্তের স্বার্থে তিনি আমাদের কী তথ্য দিয়েছেন, তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে জারার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। শিশু জারার মৃত্যুরহস্য জানার জন্য যত ধরনের ফরেনসিক পরীক্ষার প্রয়োজন, সেগুলো সবই করা হবে।’
জারারা তিন ভাইবোন। এদের মধ্যে জারা ছোট। জারার বড় ভাইয়ের নাম রাতুল (১১) আর বড় বোন ছারা (৯)। এই তিনজনই মা মৌসুমী আক্তারের (২৭) সঙ্গে রাজধানীর কদমতলী এলাকার একটি বাসায় ভাড়া থাকত। তাদের বাবা আলী হোসেন দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে থাকেন।
জারার বড় ভাই রাতুল আর বোন ছারা ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে সম্প্রতি সাক্ষী হিসেবে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের ভাষ্য, জারাকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করে তার মৃতদেহ বালতির ভেতর রেখে দেওয়া হয়
চার মাস আগে (গত ১৪ জুলাই) রাত ৪টার দিকে জারাকে বাসার বাথরুমে পানিভর্তি বালতির ভেতর পাওয়া যায়। পরে তাকে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্ত ছাড়াই শিশু জারার লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে শিশু জারাকে হত্যা করা হয়েছে, দাবি করে কদমতলী থানায় মামলা হয়েছে। সেই মামলায় মা মৌসুমী আক্তার এখন কারাগারে। পলাতক আছেন মৌসুমী আক্তারের কথিত প্রেমিক জামাল হোসেন (৩৮)।
জারার বড় ভাই রাতুল আর বোন ছারা ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে সম্প্রতি সাক্ষী হিসেবে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের ভাষ্য, জারাকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করে তার মৃতদেহ বালতির ভেতর রেখে দেওয়া হয়।
জারা খুন হয়েছে, দাবি চাচা মোহাম্মদ নূরের। হত্যা মামলার এই বাদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতটুকু বাচ্চা ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। দরজা বন্ধ করে তার মা ঘুমাচ্ছিল। তাহলে সে কীভাবে অত গভীর রাতে বাথরুমের ভেতর যাবে। আমরা মনে করি, জারাকে শ্বাস রুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে।’
অবশ্য মৌসুমী আক্তার আদালতের কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন । তাঁর দাবি, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। তিনি তাঁর সন্তান জারাকে খুন করেননি।
মামলায় নূর দাবি করেন, তাঁর ভাইয়ের ৫ লাখ টাকা আর ২০ ভরি স্বর্ণ নিয়ে মৌসুমী জামালের সঙ্গে পালিয়ে যান। জামাল আর মৌসুমী দুজনেই পরিকল্পনা করে জারাকে হত্যা করেছেন
জারার বাবা আলী হোসেন সৌদি আরবে কাজ করেন। তাঁর স্ত্রী মৌসুমী আক্তার তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে কদমতলী এলাকার কমিশনার রোডের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন।
আলী হোসেনের ছোটবেলার বন্ধু হলেন জামাল হোসেন। তিনিও কদমতলী এলাকায় থাকেন। মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, জারাসহ তিন সন্তান নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন মৌসুমী আক্তার। রাত ৪টার দিকে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। দেখেন, বিছানায় জারা নেই, অন্য দুই সন্তান রাতুল আর ছারা ঘুমাচ্ছে। তখন জারাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন মৌসুমী। পরে তিনি বাথরুমে গিয়ে জারাকে পানিভর্তি বালতির ভেতর পান। রাত ৪টার দিকে মৌসুমী তাঁর ভাশুর মোহাম্মদ নূরকে মোবাইলে এই তথ্য জানান।
পানিভর্তি বালতির ভেতর জারা পড়েছে, খবর শোনার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেখানে হাজির হন চাচা মোহাম্মদ নূর। তিনিই জারাকে ওই রাতে নিয়ে যান মিটফোর্ড হাসপাতালে।
চাচা মোহাম্মদ নূর বলেন, হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার বলেন, অনেক আগে মারা গেছে জারা। তিনি চেয়েছিলেন, জারার ময়নাতদন্ত করাতে। কিন্তু জারার মা মৌসুমী আক্তার মোটেও রাজি ছিলেন না। পরে জারাকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জারার মৃত্যুর পর গত ১ আগস্ট মৌসুমী আক্তার রাজধানীর বংশাল এলাকায় একটি বাসা ভাড়া করে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকতে শুরু করেন। মামলায় নূর দাবি করেন, তাঁর ভাইয়ের ৫ লাখ টাকা আর ২০ ভরি স্বর্ণ নিয়ে মৌসুমী জামালের সঙ্গে পালিয়ে যান। জামাল আর মৌসুমী দুজনেই পরিকল্পনা করে জারাকে হত্যা করেছেন।
জারাকে খুন করার অভিযোগ এনে গত ৬ সেপ্টেম্বর মৌসুমী আক্তার ও জামালের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে নালিশি মামলা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে গত ১১ অক্টোবর কদমতলী থানায় মামলাটি রেকর্ডভুক্ত হয়। গত ২৭ অক্টোবর জারার মা মৌসুমী আক্তার ঢাকার সিএমএম আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত তা নাকচ করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে মৌসুমীকে দুদিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে কদমতলী থানা-পুলিশ। গত ১৪ নভেম্বর তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কদমতলী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সাহিদ হাসান গত ১৫ অক্টোবর আদালতে এক প্রতিবেদন দিয়ে বলেছেন, জারার মৃত্যুর বিষয়ে তার বড় ভাই রাতুল ও বোন ছারাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। দুজনই তাকে জানিয়েছে, তাদের মা মৌসুমী আক্তার জারাকে হত্যা করেছেন। এ কথা কাউকে জানালে তাদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন আসামি মৌসুমী আক্তার।
জারার বড় ভাই রাতুল আর ছারা বর্তমানে চাচা মোহাম্মদ নূরের বাসায় থাকছে। জারার চাচি হাসিনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, রাতুল আর ছারা দুজনে আদালতের কাছে বলে এসেছে, জারাকে হত্যা করেছেন তাদের মা।
কদমতলী থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর বলেন, ‘আমরা আসামি জামাল হোসেনকে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছি । যেকোনো সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’