মোহাম্মদপুরে কাটাসুর খাল। দৈর্ঘ্য প্রায় পৌনে দুই কিলোমিটার। খালটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বারোয়ারি আবর্জনায় পূর্ণ। কোথাও কোথাও জন্মেছে বড় বড় ঘাস। স্থানীয় লোকজন বলছেন, গত বর্ষার পর তাঁরা আর খালটি পরিষ্কার করতে দেখেননি। কিন্তু ঢাকা ওয়াসার দাবি, খালটি পরিষ্কার!
ঢাকার খালগুলো সম্পর্কে ওয়াসা তার এ অবস্থান জানিয়েছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। ৬ জুলাই গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংস্থাটির ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা ওয়াসার অধীনস্থ সকল ড্রেনেজ লাইন (নালা), বক্স কালভার্ট ও খালগুলো পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে।’
এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর কাটাসুর খালসহ অন্তত পাঁচটি খাল ঘুরে প্রতিটি খালেই ময়লা-আবর্জনা, কমবেশি ঘাস, কচুরিপানা দেখা গেছে। তবে বক্স কালভার্ট ও ভূগর্ভস্থ নালাগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে কি না, আর হলেও কত কিলোমিটার হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এমন অবস্থায় ওয়াসার বিজ্ঞপ্তির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ সম্পর্কে জানতে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে সংস্থাটির ড্রেনেজ সার্কেলের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেছেন, ‘এই বিজ্ঞপ্তি কীভাবে দেওয়া হয়েছে আমার জানা নেই। সব খাল পরিষ্কারের যে তথ্য বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া হয়েছে, সেটি সঠিক নয়। তবে নালা ও বক্স কালভার্টগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে।’ একই বিভাগের আরেক কর্মকর্তা বলেছেন, এই বর্ষার আগে ২০ কিলোমিটার খাল পরিষ্কার ও প্রায় ১৪ কিলোমিটার খাল পুনঃখননের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। পুনঃখনন করলে ওই খাল আর পরিষ্কারের প্রয়োজন পড়ে না। এসব কাজসহ আরও কিছু কাজের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বরাদ্দ মেলেনি। তাই ওয়াসাও তার লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি।
ঢাকা ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, সংস্থাটির আওতায় মোট ৭৪ কিলোমিটার খাল, ৩৫০ কিলোমিটার নালা ও সাড়ে ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট আছে। খাল রক্ষণাবেক্ষণ করে ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের দুটি বিভাগ। বিভাগ-১-এর অধীনে আছে প্রায় ৪০ কিলোমিটার খাল, বাকি অংশ বিভাগ-২-এর অধীনে।
>ঢাকা ওয়াসার সব নালা-খাল পরিষ্কার করা হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ওয়াসা
সরেজমিনে ঘুরে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি
ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেল সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে ২০ কিলোমিটার খাল, ২৮০ কিলোমিটার নালা ও ৬ দশমিক ৮০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট পরিষ্কারের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। এসব কাজে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা। এই হিসাব অনুযায়ী কাজ হলেও প্রায় ৫৪ কিলোমিটার খাল, ৭০ কিলোমিটার নালা ও ৩ দশমিক ৭০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট পরিষ্কার করা হয়নি। অথচ বিজ্ঞপ্তিতে সব খাল, নালা ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কারের দাবি করা হয়েছে।
পরিষ্কার না করেও সব খাল পরিষ্কারসংক্রান্ত ওয়াসার বিজ্ঞপ্তিকে প্রহসন বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ ধরনের তথ্য দেওয়ার জন্য ওয়াসাকে প্রশ্ন করার কেউ নেই। সংস্থাটিকে জবাবদিহির মধ্যে আনবে, এমন প্রক্রিয়াও নেই। তাই এ ধরনের তথ্য দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। এটি জনসাধারণের সঙ্গে করা ওয়াসার প্রহসন।
খাল-নালা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা বলছেন, কোনো খাল বা নালা পরিষ্কার করার কয়েক মাসের মধ্যে সেটি আবার আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে যায়। তাই খাল, নালা ও বক্স কালভার্টের যে অংশ এবার পরিষ্কার করা হয়নি, সেগুলো আবর্জনায় ভরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের বিভাগ-১-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের বর্ষা সামনে রেখে (৭ জুলাইয়ের আগে) শাহজাদপুর, খিলগাঁও, জিরানি ও মহাখালী খাল মিলে মোট ১০ কিলোমিটারের মতো পরিষ্কার করা হয়েছে। এই বিভাগের অধীন বাকি ৩০ কিলোমিটার খাল পরিষ্কার করা হয়নি। এর মধ্যে বেগুনবাড়ি খাল গত চার-পাঁচ বছরের মধ্যে একবারও পরিষ্কার করা হয়নি।
বেগুনবাড়ি খালের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার। শুরুর দিকের এক কিলোমিটার দেখভালের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। সরেজমিনে এই খালটি ঘুরে (ওয়াসার অংশে) কচুরিপানা, নানা রকম ময়লার স্তূপ, বাঁশের সেতু দেখা গেছে।
একটি প্রকল্পের আওতায় বেগুনবাড়ি খাল পুনঃখননের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। জানতে চাইলে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আইনুল হক বলেন, পুনঃখননের কাজ এখনো শুরু হয়নি। অন্যদিকে ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের বিভাগ-২-এর অধীন প্রায় ৩৪ কিলোমিটার খালের মধ্যে কত কিলোমিটার পরিষ্কার করা হয়েছে আর কত কিলোমিটার পরিষ্কার করা হয়নি, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এই বিভাগের কাটাসুরসহ রামচন্দ্রপুর ও কল্যাণপুর খাল ঘুরে অপরিষ্কার দেখা গেছে।