ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁর বড় ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং ভাতিজা শঙ্খজিৎ সিংহ। এই দুজনের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে ১৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এ মামলায় মোট সাক্ষী ১৮ জন।
আগামী ১৩ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ঠিক করেছেন আদালত। আজ সোমবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪–এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম এই তারিখ ঠিক করেন।
সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) বড় ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহা আদালতকে বলেন, তিনি অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মকর্তা। এস কে সিনহা তাঁর আপন ছোট ভাই। নৌ অধিদপ্তরের প্রধান বাতিরক্ষক কর্মকর্তা হিসেবে ২০১২ সালে তিনি অবসরে যান। তাঁর ও ভাতিজা শঙ্খজিতের শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখায় একটি যৌথ হিসাব রয়েছে। ২০১৬ সালে ওই হিসাব খোলা হয়। এস কে সিনহা সরকারি পদে কর্মরত ছিলেন। তাই ব্যাংক হিসাব খোলার সমস্যা থাকায় তিনি (এস কে সিনহা) তাঁকে একটি হিসাব খুলতে বলেন। পরে তিনি উত্তরা শাখায় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে একটি হিসাব খোলেন। আগে থেকেই ওই ব্যাংকের ব্যবস্থাপক সবকিছু প্রস্তুত রেখেছিলেন। তিনি ও তাঁর ভাতিজা শঙ্খজিৎ গিয়ে কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন। ওই ব্যাংক হিসাবে তিনি কোনো টাকা জমা দেননি কিংবা কোনো টাকা সেখান থেকে উত্তোলন করেননি। কোনো চেকেও তিনি স্বাক্ষর করেননি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, তাঁদের যৌথ ব্যাংক হিসাবে দুটি চেকের মাধ্যমে টাকা গেছে। একটি চেকে টাকার পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৪৯ লাখ ৬ হাজার টাকা এবং অন্য চেকে টাকা জমা হয় ৭৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা।
নরেন্দ্র কুমার সিনহা আদালতকে আরও বলেন, উত্তরা শাখার শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে তাঁর হিসাবে এস কে সিনহার সুপ্রিম কোর্টের অ্যাকাউন্ট থেকে ওই টাকা জমা হয়।
অন্যদিকে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ভাতিজা শঙ্খজিৎ সিংহ আদালতকে বলেন, তিনি একটি পোশাক কারখানার বায়িং হাউসে কর্মরত আছেন। ঢাকা ব্যাংকের ইপিজেড শাখায় তাঁর একটি হিসাব খোলা আছে। এস কে সিনহা সম্পর্কে তাঁর দূরসম্পর্কের চাচা। তাঁর নির্দেশে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক উত্তরা শাখায় তিনি ও এস কে সিনহা একটি যৌথ হিসাব খোলেন। এস কে সিনহার নির্দেশে চেকের প্রতিটি পাতায় তিনি স্বাক্ষর দেন। এগুলোর মাধ্যমে কীভাবে টাকা তোলা হয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না। পরে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জানতে পারেন, তাঁদের শাহজালাল ইসালামী ব্যাংক উত্তরা শাখার হিসাবে এস কে সিনহার সুপ্রিম কোর্টের ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা জমা হয়। এই মামলায় গত ১৩ আগস্ট সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
কারাগারে থাকা তৎকালীন দি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডের নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীকে (বাবুল চিশতী) কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়।
আদালতে হাজির ছিলেন জামিনে থাকা মামলার আসামি দি ফারমার্স ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ক্রেডিটপ্রধান গাজী সালাহউদ্দিন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীম, সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায় ও ভাইস প্রেসিডেন্ট লুৎফুল হক এবং টাঙ্গাইলের মো. শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা। এ মামলায় পলাতক চারজন। তাঁরা হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, দি ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখার ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সফিউদ্দিন আসকারী, এস কে সিনহার কথিত পিএস রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও রণজিতের স্ত্রী সান্ত্রী রায় (সিমি)।
আদালতে উপস্থিত ছিলেন আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল গনি ও শাহিনুর ইসলাম
কীভাবে দুর্নীতি সংগঠিত হয়, সে ব্যাপারে মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেন আদালতকে বলেছিলেন, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আসামি নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ও শাহজাহান তৎকালীন দি ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) গুলশান শাখায় দুটি চলতি হিসাব খোলেন। পরদিন পৃথক দুটি হিসাবের বিপরীতে দুই কোটি করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করা হয়। ঋণের আবেদনপত্রে ঠিকানা হিসেবে উত্তরার একটি বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়। যে বাড়ির মালিক এস কে সিনহা। তৎকালীন দি ফারমার্স ব্যাংকের কর্মকর্তা মামলার আসামি জিয়াউদ্দিন আহমেদ, সফিউদ্দিন আসকারী ও লুৎফুল হক ঋণ আবেদন যাচাই-বাছাই না করে এই ব্যাংক এবং ব্যাংকের কোনো নীতিমালা না মেনেই ঋণ প্রস্তাব প্রস্তুত করেন। এতে নিজেরা স্বাক্ষর করেন। আসামে জিয়াউদ্দিন আহমেদ ঋণ প্রস্তাবটি হাতে হাতে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যান।
দুদক কর্মকর্তা বলেন, দি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা স্বপন কুমার রায় কোনো যাচাই-বাছাই না করে ওই ঋণ প্রস্তাব দুটি অনুমোদনের জন্য নোট আকারে উপস্থাপন করেন। ব্যাংকটির ক্রেডিট শাখার গাজী সালাউদ্দিনের কাছে নিয়ে যান।
তিনিও কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করে ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামীমের কাছে নথিটি নিয়ে যান। ব্যাংকের ঋণনীতি অনুযায়ী এ ধরনের ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের না থাকা সত্ত্বেও অবৈধ প্রক্রিয়ায় তিনি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেন। পরদিন ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন সাহার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অনুমোদিত ঋণের টাকা এস কে সিনহার নামে পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। ওই বছরের ৯ নভেম্বর সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার ব্যাংক হিসাবে চার কোটি টাকা জমা হয়।
দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেন আদালতকে আরও বলেন, সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখায় টাকা জমা হওয়ার পর এস কে সিনহা বিভিন্ন সময় টাকা তুলে তা হস্তান্তর–স্থানান্তর করেন। এর মধ্যে ওই বছরের গত ২৮ নভেম্বর দুটি চেকের মাধ্যমে এস কে সিনহা তাঁর আপন ভাইয়ের শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার হিসাবে ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ও ৭৪ লাখ টাকা স্থানান্তর করেন। ওই টাকাও পরে স্থানান্তর–রূপান্তর করা হয়। মামলার আসামি রণজিৎ চন্দ্র সাহা এই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সময়ে নিজে ব্যাংকে উপস্থিত থেকে এস কে সিনহার নাম উল্লেখ করে ভুয়া ঋণ অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন। ঋণ আবেদনকারী নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা আসামি রণজিৎ চন্দ্র সাহার ভাইপো। অপর ঋণ আবেদনকারী শাহজাহান রণজিৎ চন্দ্র সাহার বাল্যবন্ধু। আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা দুজনই গরিব ও দুস্থ, তাঁরা ব্যবসায়ী নন।