চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে ৭১ জনের মৃত্যুর তিন বছর আজ। পুরান ঢাকায় আগের মতোই চলছে রাসায়নিক ব্যবসা।
১২ বছরেও রাসায়নিকপল্লি প্রতিষ্ঠার কাজ শেষ হয়নি। চলছে মাটি ভরাট।
অস্থায়ী গুদাম তৈরির কাজও শেষ করতে পারেনি সরকারি সংস্থা।
পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে ৭১ জনের মৃত্যুর তিন বছর হলো আজ রোববার। এই দিনে এসে দুটি দিক দেখা যাক।
প্রথমত, এই দুর্ঘটনার পর শিল্প মন্ত্রণালয় দ্রুততম সময়ের মধ্যে অস্থায়ী গুদাম তৈরি করে পুরান ঢাকার রাসায়নিকের ব্যবসা সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিল। এখন পর্যন্ত সেই অস্থায়ী গুদাম তৈরির কাজই শেষ হয়নি। আর রাসায়নিক শিল্পপল্লির মাটি ভরাটের কাজও শেষ করা যায়নি।
দ্বিতীয়ত, পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের ব্যবসা আগের মতোই চলছে। এমনকি সরকারি সংস্থার অভিযানে যেসব গুদাম সিলগালা করে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো খুলেছে।
অবশ্য শুধু এই তিন বছর নয়, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের ব্যবসা সরিয়ে নেওয়ার আলোচনা জোরেশোরে শুরু হয় ২০১০ সালে। ওই বছর নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদামে আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে সময় গেছে ১২ বছর। পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরানো যায়নি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি সংস্থা এ ক্ষেত্রে চরম গাফিলতি দেখিয়েছে। এ জন্য তাদের জবাবদিহিও করতে হয়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা রাজিয়া প্রথম আলোকে বলেন, আবাসিক এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক মজুত করলে ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি হয়। প্রকল্পের এই ধীরগতির মাশুল হয়তো বড় কোনো দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে দিতে হবে।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিকের ব্যবসা সরিয়ে নিতে শিল্প মন্ত্রণালয় দুটি জায়গায় অস্থায়ী গুদাম তৈরির উদ্যোগ নেয়। নেওয়া হয় ১৬৮ কোটি টাকার প্রকল্প। জায়গা দুটি হলো শ্যামপুরের উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জমি ও টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া মৌজায় বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) জমি।
উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে অস্থায়ী গুদাম তৈরির কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। অথচ কাজ এখনো চলছে। গতকাল শনিবার উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সেখানে ৫৪টি অস্থায়ী গুদামের মধ্যে ৩৩টির কাজ শেষের দিকে। ৭টির কাজ শুরুই হয়নি। বাকিগুলোর কাজ মাঝামাঝি।
অন্যদিকে টঙ্গীতে বিএসইসির জমিতে রাসায়নিক গুদাম হবে মোট ৫৩টি। ৭টি গুদাম নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। ৪৬টির নির্মাণকাজ চলছে। প্রকল্পের পরিচালক খন্দকার জহিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত পুরো প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৪০ শতাংশ। বাকি কাজ শেষ হতে সময় লাগবে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
রাসায়নিকপল্লি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১০ সালে নিমতলীর আগুনের পর। চুড়িহাট্টার আগুনের পর পল্লির প্রস্তাবিত স্থান পরিবর্তন করা হয়, মুন্সিগঞ্জে ৩১০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, রাসায়নিকপল্লির প্রকল্পের জমিতে মাটি ভরাটের কাজ এখনো শেষ হয়নি।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজ ৭০ শতাংশ হয়েছে। তবে এ বছর এই প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব নয়।
চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে গিয়ে গত সোমবার দেখা যায়, পুরো ভবন সংস্কার করা হয়েছে। নিচতলায় ১৬টির মধ্যে ৪টি দোকান ভাড়াও দেওয়া হয়েছে।
এদিকে পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় রাসায়নিকের ব্যবসা যেমন ছিল, তেমনই আছে। আবাসিক এলাকায় দোকান, গুদাম ও কারখানা—সবই চলছে ঝুঁকি নিয়ে। ঘুরে দেখা যায় অলিগলিতে গুদাম ভাড়ার বিজ্ঞাপন।
চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকার অবৈধ রাসায়নিকের গুদাম চিহ্নিত করে অভিযান শুরু করেছিল একাধিক সরকারি সংস্থা। তবে কিছুদিন পরই সেই অভিযানে ভাটা পড়ে। ওই সময় সিলগালা করে দেওয়া গুদাম নতুন করে চালু হয়েছে।
যেমন ২০২০ সালের আগস্টে টিকাটুলীর হাটখোলা সড়কে ১০ তলা রাসেল সেন্টারে অভিযান চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক পাওয়ায় পাঁচটি দোকান ও গুদাম সিলগালা করে দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আটটি মামলা করা হয়। অভিযানে ছয়জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। তবে সব গুদাম খুলে দেওয়া হয়েছে। এই ভবনের চারতলা পর্যন্ত বিপণিবিতান এবং বাকি ছয়তলা আবাসিক।
রাসেল সেন্টারে গেলে গতকাল ইয়াসিন সায়েন্টিফিক নামের একটি রাসায়নিকের দোকানের মালিক আবদুস সালাম বলেন, তাঁরা আদালতে গিয়ে দোকান খোলার অনুমতি পেয়েছেন।
পুরান ঢাকার রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন তাঁদের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। নবায়নও করা যাচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংক হিসাব খোলা যায় না। বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে চলতে হয়। সবাই মিলে একটা জায়গায় ব্যবসা সরিয়ে নিতে পারলেই ভালো।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নুরুল মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাসায়নিকপল্লির কাজ কবে শেষ হবে, সেটি আমরা জানি না। সরকারকে বারবার বলছি, তবে কাজ হচ্ছে না।’
নিমতলীর আগুনের পর পুরান ঢাকায় বড় দুর্ঘটনা ছিল চুড়িহাট্টা। এরপর আরমানিটোলায় আগুনে গত বছরের এপ্রিলে পাঁচজন মারা যান। নভেম্বরে মারা যান সোয়ারীঘাটের একটি জুতার কারখানায় আগুনে ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যান আরও পাঁচজন।
চুড়িহাট্টার আগুনে দুই সন্তান হারানো সাহেব উল্লাহ বলেন, ‘এত বড় ঘটনা ঘটল, ছেলে গেল, ব্যবসা গেল; তারপরও কারও তো টনক নড়ল না।’
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আল-আমিন, সংবাদদাতা, গাজীপুর]