এক চারণের চলে যাওয়া

কামাল লোহানী। ছবি: সংগৃহীত
কামাল লোহানী। ছবি: সংগৃহীত

শনিবার সকাল দশটা একত্রিশ মিনিটে উর্মি লোহানীর এসএমএস: ‘চলে গেলেন।’

বলে দিতে হলো না কার কথা বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় কামাল লোহানীর শোকগ্রস্ত সন্তানের কাছে ফোন করা যায় কি না, সে ভাবনাকে আমলে না নিয়ে ফোন করি। মা দীপ্তি লোহানী কয়েক বছর আগে যখন চলে গেলেন, তখনো উর্মি লোহানীকে শান্ত দেখেছি। আমাদের সামনে কাঁদেননি। এবারও শান্ত। বললেন, ‘বাবাকে আমরা উল্লাপাড়া নিয়ে যাচ্ছি। তার আগে উদীচীতে থাকবেন।’

সকালে কামাল লোহানী চলে গেছেন। ফুসফুস, কিডনি নিয়ন্ত্রণে ছিল না তাঁর। ডায়াবেটিসও কষ্ট দিচ্ছিল। করোনা এসে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল জীবন থেকে।

কোন কামাল লোহানীর কথা বলছি আমরা? সাংবাদিক? সংস্কৃতিকর্মী? সংগঠক? এর যেকোনো পরিচয়েই তিনি মানিয়ে যাবেন। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাবে, পূর্ণ গভীরতা নিয়ে কাজ করে গেছেন। আমরা আসলে একজন গণসংস্কৃতির রূপকারকে নিয়ে কথা বলছি, যিনি গণসংগীত ও গণসংস্কৃতিকে সঙ্গী করে চারণের বেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন গোটা দেশ।

মনে আছে, ২০০৭ সালে স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর লাশের সামনে বুকে হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে ছিলেন কামাল লোহানী। বিষণ্নতার প্রতিমূর্তি যেন। তাঁর কাছে আমরা যারা দাঁড়িয়ে ছিলাম, তাদের বলছিলেন, ‘এই ভদ্রমহিলাকে কিছুই দেবার সাধ্য ছিল না, মন ছাড়া।’

আমরা বুঝতে পারছিলাম, বুকে কষ্টের একটা পাহাড় ধারণ করে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছেন তিনি। সেদিনই জানা হয়ে গিয়েছিল, স্ত্রী ছিলেন তাঁর চাচাতো বোন। মন দেওয়া–নেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সে সময় জেলে যাওয়ার পর পারিবারিকভাবে দীপ্তিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। দীপ্তি চলে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। এরপর ফিরে এলে আবার মিলন। বিয়ে হলো নারিন্দা ম্যারেজ রেজিস্ট্রার অফিসে। ১৯৬০ সালে। রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে ব্যস্ত পরিবারে স্থায়ী আয় ছিল দীপ্তি লোহানীর স্কুল থেকে পাওয়া মাইনে।

২.

দুইটা আটান্ন মিনিটে উর্মি লোহানীর আরেকটি এসএমএম, ‘বাসার ছবিগুলো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।’

মনে পড়ল, সদা হাস্যময় দীর্ঘাঙ্গী মানুষটির কথা। দেয়ালে টানানো তাঁর ছবিগুলোর কথা। হ্যাঁ, এমন আপন করে নিতে জানতেন মানুষকে, যে সব সময়ই মনে হতো, এই তো তিনি দাঁড়িয়ে আছেন পাশেই। রাশভারী ভরাট মসৃণ কণ্ঠে যখন কথা বলতেন, মনে হতো, বাংলা ভাষার মাধুর্য নিয়ে যে গর্ব করা হয়, তা এ ধরনের কণ্ঠ আছে বলেই। আর হাসি? এতটা উদাত্ত বাধাহীন হাসির অধিকারী হয় খুব কম মানুষই।

১৯৫২ সাল এসে যে তাঁর জীবনটা পাল্টে দিয়েছিল, সেটা কমবেশি সবাই জানে। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। ঢাকায় রক্ত ঝরেছে শুনে পাবনার বিক্ষোভ মিছিলে দেখা যায় তাঁকে। পরের বছরই মুসলিম লীগের কাউন্সিল হচ্ছিল পাবনার জিন্নাহ পার্কে। নুরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতারা এসেছিলেন। তাঁদের ছাত্র হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে যে বিক্ষোভ হয়, তা থেকে কামাল লোহানীকে প্রথম গ্রেপ্তার করা হয়। তখন তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র। যুক্তফ্রন্টের পক্ষে ১৯৫৪ সালে কাজ করার সময় আবার গ্রেপ্তার হন তিনি। এ সময় রাজনীতি ও সংস্কৃতি একসঙ্গে দখল করে নেয় তাঁকে। যার ফলে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেন না আর। পরের বার গ্রেপ্তার হয়ে মুক্তি পান ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে। তিনি গোঁ ধরে বসেন, পড়াশোনা আর নয়, এবার রাজনীতি। বামপন্থা তখন তাঁর শিরায়–শোণিতে।

ছোট চাচার কাছ থেকে ১৫ টাকা হাতে নিয়ে ঢাকার পথে যাত্রা। আসলে নিরুদ্দেশযাত্রা। প্রথমে জগন্নাথ সাহা রোডে এক বন্ধুর বাড়িতে উঠলেন। সারা দিন হেঁটে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ান। এ সময় চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তিনি তখন বেশ নাম করেছেন। তিনিই নিয়ে গেলেন মিল্লাত সম্পাদক সিকান্‌দার আবু জাফরের কাছে। তিনি পাঠালেন বার্তা সম্পাদক নূরুল ইসলাম পাটোয়ারির কাছে। পাটোয়ারি সাহেব জানালেন, সুযোগ নেই। অনুরোধ করা হলো, চাকরি না হোক, শিখতে থাকুক। কদিন পর থেকেই খাতায় সই করতে শুরু করলেন কামাল লোহানী। মানে চাকরি হয়ে গেছে। ৮০ টাকা বেতনে কামাল লোহানী চাকরি শুরু করলেন।

ওদিকে কণ্ঠস্বর ভালো, উপস্থাপনা করতে পারেন, ফলে সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকল। তার আগে বলে নেওয়া ভালো, নিউজ ডেস্ক আর ইউনিয়নের কর্মকাণ্ড একসঙ্গে চালাতে গিয়ে জীবনের স্পন্দনকে ঠিক চিনে নিলেন। যুক্ত হলেন ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে।

তবে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের রাজনীতি যখন সামরিক আইন দেখল, তখন আত্মগোপনে যেতে হলো কামাল লোহানীকে। আর তার পরপরই নৃত্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো তাঁর। বুলবুল একাডেমিতে জি এ মান্নানের প্রযোজনায় নক্সী কাঁথার মাঠ–এ অংশ নিলেন তিনি। সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হয়ে সফর করলেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান, এরপর ইরাক, ইরান। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে শ্যামা নৃত্যনাট্যে বজ্রসেন হলেন।

৩.

উর্মি লোহানীর এসএমএস, ‘আমরা বাইপাইল পার হলাম।’

কী বিষণ্ন কয়েকটি শব্দ!

হ্যাঁ, কামাল লোহানী রওনা দিয়েছেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার দিকে। তিন সন্তান—সাগর লোহানী, বন্যা লোহানী ও উর্মি লোহানী চলেছেন সঙ্গে। সেখানেই হবে তাঁর শেষশয্যা।

এর আগে উদীচীতে রাখা হয়েছিল তাঁকে। এই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। গণসংগীত, নাচ তথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর নিবিড় যোগাযোগের একটি বড় জায়গা এই উদীচী। এর আগে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর পর যখন ছায়ানট গঠিত হলো, তখন সে সংগঠনের দ্বিতীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন কামাল লোহানী। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর গণসংগঠন ক্রান্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

সাংবাদিকতার সুবাদে পরিচয় হয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী বদরুল হাসানের সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকেই পাঠ আর ধারাবিবরণী শিখে নিয়েছিলেন কামাল লোহানী। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ মিনার, পল্টন ময়দান বা বাংলা একাডেমির বটতলায় যত গণসংগীতের অনুষ্ঠান হয়েছে, তার প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি। এ ব্যাপারে হেসে বলতেন, ‘আমি তো গান গাইতে পারতাম না, তাই গাওয়ানোই ছিল আমার দায়িত্ব। এই কাজে যাঁদের সঙ্গে আমার সখ্য প্রায় পারিবারিক, তাঁরা হলেন শেখ লুৎফর রহমান, আব্দুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদ, আবদুল হাকিম, খান আতাউর রহমান, নিজামুল হক, সুখেন্দু চক্রবর্তী, নুরুল ইসলাম, অজিত রায়, সাইদুল ইসলাম, শম্ভু জোয়ারদার প্রমুখ গণসংগীতশিল্পী।’

এরপর একটু থেমে, যেন যাকে বলা হচ্ছে, তিনি বুঝতে পারেন, এমনভাবে বলতেন, ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীকে নিয়ে বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গেছি, পল্টন থেকে টঙ্গী, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের জাম্বুরি ময়দান, কুলাউড়ার কৃষক সম্মেলন থেকে নওগাঁর ঈদগাহ, এই সব জায়গায় গেছি মার্ক্সবাদের টানে। আমরা সমাজবদলের গান গেয়ে মহান মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।’

৪.

সাংবাদিক হিসেবে আরও চাকরি করেছেন দৈনিক আজাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক জনপদ, দৈনিক বঙ্গবার্তা দৈনিক বার্তায়। দুই দফায় শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হয়েছেন। প্রথম দফায় প্রতিমন্ত্রীর রোষে পড়ে সেখান থেকে সরে আসেন পিআইবিতে। দৈনিক বার্তায় কাজ করার সময় রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গী হয়ে বিদেশ সফরের সময় পোশাক–বিড়ম্বনার কারণে যাননি। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর চিরাচরিত পায়জামা–পাঞ্জাবি পরে যাবেন। জিয়াউর রহমানের সামরিক সচিব বললেন, স্যুট পরে যেতে হবে। ফলে তিনি যাননি।

এর আগে বাংলার বাণীতে চাকরি করার সময় বাকশালে যোগ দেননি। চাকরি হারিয়েছিলেন। কায়ক্লেশে জীবন কেটেছিল তখন।

৫.

উর্মি লোহানীর আর এসএমএস নেই। এ সময় কেউ এসএমএস দেয় না। কিন্তু তাঁর শক্ত স্নায়ুর কথা জানি বলেই রাত নয়টা চুয়ান্ন মিনিটে তাঁকে ফোন করি। 

‘আপনারা কোথায়?’

‘মসজিদের সামনে। আর একটু পরেই…’

কথা শেষ করেন না তিনি। একটু সময় নিয়ে বলেন, ‘আমরা আর বাড়ি যাব না। এখান থেকেই একটু পর ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেব।’

হ্যাঁ, লোহানী পরিবার তাঁদের সেই প্রতিনিধিকে রেখে আসছেন উল্লাপাড়ায়, যিনি সারাজীবন নির্লোভ জীবন কাটিয়েছেন। সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে যিনি পূর্ণতায় অবগাহন করেছেন। তিনি কামাল লোহানী, যাঁর কণ্ঠে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ধ্বনিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বার্তা। তিনিই তো ২২ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানে করে কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরেছিলেন বেতারের দায়িত্ব বুঝে নিতে। সেদিনই মুজিবনগর সরকার ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে তার ধারাবিবরণী দিতে হয়েছিল তাঁকে। সঙ্গে ছিলেন এম আর আখতার মুকুল।

২০২০ সালের ২০ জুন তারিখটি আলাদা করে স্মরণ করতে হবে পরবর্তীকালে। এই দিন চলে গিয়েছেন এ দেশের গণসংস্কৃতির অন্যতম সেরা প্রতিনিধি কামাল লোহানী।