>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com
সময়টা জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। রাত ১১টায় সেলফোনের রিং বেজে উঠল। আমার স্ত্রী আর আমি একসঙ্গে সমস্বরে বলে উঠলাম, ‘ছেলের ফোন, ধরো।’ আমরা দুজনই উৎকণ্ঠিত হয়ে ছিলাম। উৎকণ্ঠার কারণ আছে। আমাদের বড় ছেলেটা থাকে চীনের উহানে। উহানের একটি পাবলিক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সে পরিবেশ প্রযুক্তিতে পিএইচডি করছে। বছর তিনেকের বেশি হলো আছে। প্রতি সেমিস্টার শেষে ছুটিতে দেড়-দুই মাসের জন্য দেশে আসে।
এ সময়টাতে এমনিতেই রোজ ওর ফোনের অপেক্ষা করি। কোনো দিন করা সম্ভব না হলে আগে থাকতেই জানিয়ে দেয়। জানে, ওর ফোনকলের জন্য আমরা অপেক্ষা করতে থাকি! তাই ওখানে সময় রাত একটা হলেও ফোন সে করবেই।
জিজ্ঞেস করি, ওখানকার অবস্থা কেমন? ছেলের কণ্ঠ আড়ষ্ট। ওর মা-ও ততক্ষণে পাশে এসে বসেছে। ‘কী হয়েছে রে?’ ওর মায়ের কণ্ঠে উদ্বেগ। ডিসেম্বরের শেষ দিনে উহানে করোনাভাইরাস ধরা পড়ার কথা ছেলের মুখেই প্রথম শুনেছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি এখন খুবই খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস অবরুদ্ধ। কড়াকড়ি কোয়ারেন্টিনে কারোরই বাইরে বেরোনোর উপায় নেই।
চীনের নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয় উহানে। লকডাউনে সব বন্ধ। উহান ছেড়ে চলে যেতে সবাই তখন মরিয়া। স্থানীয়রা আশ্রয় নিয়েছে গ্রামের বাড়িতে। যারা থেকে গেল, তারা খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করল ছাত্রাবাসের কক্ষে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভেতরের দোকান থেকে চাল, ডাল, হিমায়িত মুরগি কিনে রাখা হলো, যাতে মাসখানেক চলে।
উহানের ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা শুনে ছেলের জন্য ভয়ে বুক কাঁপে। ফোনে বারবার বলতে থাকি, ‘যেভাবে পারো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করো।’
একসময় উহানে থাকা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। দূতাবাসে চলে নামের তালিকাভুক্তি। আমার ছেলেও তার নাম লেখাতে সক্ষম হয়। এরপর সুনির্দিষ্ট একটি তারিখে উহানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১৭ জন শিক্ষার্থীকে কঠোর নিরাপত্তায় আনা হয় বিমানবন্দরে। বিমানবন্দরে তখন বিভিন্ন দেশের আকাশযানের জট লেগে গেছে। বহু দেশই তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিতে তৎপর। আমরা প্রমাদ গুনতে থাকি। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পর অবশেষে বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটটি শিক্ষার্থীদের নিয়ে ডানা মেলে।
১ ফেব্রুয়ারি বিমান বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর শুরু হয় আরেক উদ্বেগ। ওরা বাড়ি ফিরতে পারবে না, জানি, কিন্তু কোথায় রাখা হবে, তা জানি না। উদ্বেগাকুল হয়ে টেলিভিশনে ছেলের মুখটা একবার দেখার চেষ্টা করি। লাভ হয় না। নানা জল্পনার পর হাজ ক্যাম্পে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় উহান-প্রত্যাগতদের। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা চলল। কিন্তু মা-বাবার দুশ্চিন্তা কি আর দূর হয়?
১৪ দিন পর কোয়ারেন্টিন শেষ হলে ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি নির্দেশনামা আর কোয়ারেন্টিনের মেয়াদ সমাপ্ত করার সনদ দিয়ে ওদের ছেড়ে দেওয়া হয়। আমাদের ছেলে চলে যায় গেন্ডারিয়ায়, তার স্ত্রী-সন্তানের কাছে। পুরো একটা মাস সে বাসায় স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ হয়ে থাকে। নিজের সন্তানকেও কাছে টেনে নিতে ভয়, পাছে করোনার সংক্রমণ ঘটে। এদিকে আশপাশে রটে গেছে, এই বাড়িতে উহান থেকে লোক এসেছে, ব্যস। সেই ভয়ংকর আচরণ না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন, মানুষ এমনও হতে পারে। দুর্বিষহ এক মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে বাকি দিনগুলো পার করতে হয় তাকে।
অবশেষে এই মার্চে দেখা হলো ছেলের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জন্মানো ছেলে। আবেগে জড়িয়ে ধরি। ও তো আমাদের কাছে এখনো শিশুই রয়ে গেল।