‘আহ! আমার পাখিটা বিদায় দিলাম, চিরবিদায় হয়ে গেল’

নাঈম হাসান
সংগৃহীত ছবি

মো. শাহ আলম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারে বসেছিলেন বুধবার দুপুরে। তাঁর ছোট ছেলেটা কুড়ি-পঁচিশ গজ দূরের একটা ঘরে শুয়ে। নটর ডেম কলেজের ইউনিফর্ম পরে বেরিয়েছিল, বাবার তখন অপেক্ষা কাফনের কাপড় গায়ে জড়িয়ে ছেলেকে নিয়ে ফেরার।

মো. শাহ আলমকে ঘিরে একসময় ছোটখাটো জটলা তৈরি হয়। সেখানে তাঁর বড় ছেলে মুনতাসির মামুন ও মুনতাসিরের এক বন্ধু ছাড়া বাকিরা অপরিচিত। কারও পরনে পাঞ্জাবি, কেউ পরে আছেন লুঙ্গি ও ফুলহাতা গেঞ্জি, কারও পরনে শাড়ি, কারও কোলে শিশু। তাঁরা নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করেন, কেউ আবার ছেলেটা নটর ডেম কলেজের, আজই দুপুর ১২টায় রাস্তা পার হতে গিয়ে মারা গেছে এমন সব বিবরণ দেয়। উৎসুক মানুষের প্রশ্নে কেউ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। শুধু নাঈম হাসানের বাবার সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি নিজের মতো করে কেঁদে যান। মৃত ছেলের সঙ্গে তিনি অবিরাম কথা বলেন।

বাবাকে বলতে শোনা যায়, ‘বলেছিলে না, বাবা, আমাকে আর হাত ধরে পার করে দিতে হবে না? আমি একাই পারব? আহ! আমার পাখিটা! আমি সকালে বিদায় দিলাম, চিরবিদায় হয়ে গেল?’ বড় ছেলে মুনতাসির কাগজ দিয়ে বাবাকে বাতাস করে, তাঁর শার্টের বোতামগুলো খুলে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে।

একটা সময় বাবাকে ধরাধরি করে দূরে কোথায় নিয়ে বসায় মুনতাসির। সন্ধ্যা ৭টায় তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে নাঈমের লাশ নিয়ে কামরাঙ্গীরচরের বাসায় যান। জানাজার পর বুধবারই তাঁদের মৃতদেহ নিয়ে লক্ষ্মীপুরে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার কথা।

দুপুর ১২টায় দুর্ঘটনাটি ঘটার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে। হাসপাতালে আসে নাঈমের ছোটবেলার বন্ধুরা। তানজিম রায়হান নামে নাঈমের এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হয়। সে জানায়, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে টানা চার বছর একসঙ্গে বসেছে ওরা, ভাগাভাগি করে টিফিন খেয়েছে, নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গল্প করেছে, কখনো ফুটবল খেলেছে। ল্যাবরেটরি স্কুলের মাঠ এখনো ওদের আড্ডার প্রিয় জায়গা। বুধবারও ওখানে বসেই শোনে নাঈমের মৃত্যুর সংবাদ।

বলতে বলতেই তানজিম রায়হান আলগোছে চোখ মোছে। নাঈমের বন্ধুরা জানায়, সে শান্ত ছিল, কিন্তু রসিক। টুকটুক করে গল্প করত। ফুটবলে টটেনহ্যামের সমর্থক ছিল। কখনো কারও সঙ্গে মারামারিতে জড়ায়নি। অন্য বন্ধুরা যখন ঢাকা কলেজ কিংবা সিটি কলেজে ভর্তির জন্য দৌড়ঝাঁপ করেছে ও ভর্তি হয়েছে নটর ডেমে। সে বলেছিল, নিরিবিলি থাকতে চায়। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিকে জিপিএ–৫ পেয়েও মানবিকে ভর্তি হয়। ও আইন পড়তে চেয়েছিল, বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিল।

ছেলে নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা শাহ আলম

ঠিক কোথায় সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল? গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু স্কয়ারে সেই জায়গায় গিয়ে দেখা যায় নটর ডেম কলেজের পোশাক পরা ছেলেরা দল বেঁধে আসছে। তারা সহপাঠী হত্যার বিচার চায়। ইউনিফর্ম খুলে পিঠে লেখে, ‘আমি বাঁচতে চাই’, খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে লেখে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, লেখে ‘নাঈম হত্যার বিচার চাই’, জানতে চায়, ‘আমার ভাই মরল কেন?’ তারা মিছিল নিয়ে গুলিস্তান থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কার্যালয় নগর ভবনের দিকে যায়। ভবনের ফটক বন্ধ। আবার মিছিল করে যায় সেই বঙ্গবন্ধু স্কয়ারেই।

নাঈমের সহপাঠীদের দাবি সেই একটাই, তারা নিরাপদ সড়ক চায়। একদল ছাত্রের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক এই ছেলেরা নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চায়নি। কেন নটর ডেমের ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছে, জানতে চাইলে ছাত্ররা পাল্টা প্রশ্ন ছোড়ে একের পর এক, কেন নামব না? আমাদের সহপাঠী কেন মরল? কেন তাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে হলো? কেন ময়লার গাড়ি দুপুর ১২টায় এমন বেপরোয়া গতিতে চলে? কেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ফটক বন্ধ?