আহমদ শফীর বক্তব্যে ক্ষোভ, প্রত্যাহার দাবি

সুলতানা কামাল, আহমদ শফী, মহিবুল হাসান চৌধুরী
সুলতানা কামাল,  আহমদ শফী, মহিবুল হাসান চৌধুরী
>
  • শিক্ষার মূল সূচকগুলোতেই মেয়েরা এগিয়ে
  • আহমদ শফী মেয়েদের স্কুল-কলেজে না পাঠাতে বলেছেন
  • শফীর বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া
  • রাজনৈতিক, মানবাধিকার ও নারী সংগঠন বক্তব্য প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছে

দেশের শিক্ষায় যত অগ্রগতি হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে মূল সূচকগুলোতেই মেয়েরা এগিয়ে। কর্মক্ষেত্রেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশ প্রশংসিত হচ্ছে, স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কার অর্জন করেছে।

এমন পরিস্থিতিতে হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী গত শুক্রবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে মেয়েদের স্কুল-কলেজে না পাঠাতে বলেছেন। আর পাঠালেও চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর এই বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কয়েকটি রাজনৈতিক, মানবাধিকার ও নারী সংগঠন এই বক্তব্য প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, আহমদ শফী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সরাসরি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেউ সংবিধানবিরোধী কথা বললে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের নিশ্চয়ই কোনো না কোনো নীতি আছে। এ ক্ষেত্রে সরকার কী পদক্ষেপ নিল, তা দেখতে চান সুলতানা কামাল।

এ প্রসঙ্গে সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী গতকাল চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, যিনি এই মন্তব্যটা করেছেন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মতামত দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষানীতি প্রণয়ন বা শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা বা শিক্ষা খাতে কোনো নির্বাহী দায়িত্বে নেই। তাঁর এই বক্তব্য রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

শিক্ষায় নারীর অগ্রগতি
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে প্রাথমিকের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫০ দশমিক ৮৫ শতাংশই মেয়ে। মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হওয়া মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশই ছাত্রী। উচ্চমাধ্যমিকেও মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ মেয়ে।

শিক্ষক হিসেবেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। প্রাথমিকে মোট ৩ লাখ ৭০ হাজার ১২৯ জন শিক্ষকের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ নারী শিক্ষক। অবশ্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে ৬০ শতাংশ নারী কোটা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সেই কোটার চেয়ে এখন বেশি নারী শিক্ষক রয়েছেন।

মাধ্যমিকে মোট শিক্ষকের মধ্যে ২৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ নারী। অথচ ১৮ বছর আগে ২০০০ সালেও এই স্তরে নারী শিক্ষকের হার ছিল ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ। আর উচ্চমাধ্যমিক স্তরে নারী শিক্ষক ২৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

শুধু সাধারণ শিক্ষাই নয়; দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসাতেও নারী শিক্ষার্থী বেশি। এসব মাদ্রাসায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৫ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। তবে মাদ্রাসায় নারী শিক্ষক কম (১৩ দশমিক ১১ শতাংশ)।

সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩২ দশমিক ৫৭ নারী। পেশাগত শিক্ষার ক্ষেত্রেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। বর্তমানে পেশাগত শিক্ষায় ৪৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ নারী। অথচ ২০০০ সালেও এই হার ছিল ৩৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

পরীক্ষার ফলাফলেও মেয়েরা ভালো করছে। যেমন, গত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে পাসের হারে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এগিয়ে ছিল। অবশ্য জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে ছেলেরা এগিয়ে ছিল। ওই পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী, মেয়েদের পাসের হার ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ছেলেদের পাসের হার ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এসএসসিতেও মেয়েরা কয়েক বছর ধরে পাসের হারে ভালো করছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে নারী-পুরুষের সমতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশের ওপরে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। চারটি ক্ষেত্রে আবার বাংলাদেশ বিশ্বের সব দেশের ওপরে স্থান পেয়েছে। এই চারটি ক্ষেত্রের তিনটি হলো, ছেলে ও মেয়েশিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি, মাধ্যমিকে ছেলে ও মেয়েদের সমতা এবং সরকারপ্রধান হিসেবে কত সময় ধরে একজন নারী রয়েছেন। চতুর্থ ক্ষেত্রটিতে অবশ্য মানুষের হাত নেই। সেটি হলো জন্মের সময় ছেলে ও মেয়েশিশুর সংখ্যাগত সমতা।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারীদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের বক্তব্য অযৌক্তিক, হাস্যকর ও অবান্তর। তিনি এমন বক্তব্য দেওয়ার স্পর্ধা কীভাবে পেলেন, তা জানতে চাই।’

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা মনে করেন, তিনি দেশদ্রোহী বক্তব্য দিয়েছেন, এ জন্য তাঁর বিচার হওয়া উচিত।

হেফাজত আমিরের ব্যাখ্যা
গতকাল শাহ আহমদ শফীর কার্যালয় থেকে তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আমাকে নারীবিদ্বেষী ও নারীশিক্ষাবিদ্বেষী বলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।’ তিনি বলেন, ‘আমি মূলত বলতে চেয়েছি, ইসলামের মৌলিক বিধান পর্দার লঙ্ঘন হয়, এমন প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের পড়াশোনা করানো উচিত হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এখানে শিক্ষা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ যাবতীয় সকল কিছুই রয়েছে।’

ব্যাখ্যায় বলা হয়, তিনি বলতে চেয়েছেন, শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে যেন পর্দার বিধান লঙ্ঘন করা না হয়। কারণ, দেশের বেশির ভাগ সাধারণ শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে সহশিক্ষা দেওয়া হয়, অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে একই সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। এতে করে পর্দার লঙ্ঘন হয়। তিনি মূলত এই সহশিক্ষা গ্রহণের বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করতে চেয়েছেন।

আহমদ শফীর বক্তব্যের প্রতিবাদ
হেফাজতের আমিরের বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে কয়েকটি সংগঠন। নারীপক্ষ বলেছে, এই বক্তব্য দেশ ও জাতির জন্য অপমানকর। এ বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, তা দেখতে চায় সংগঠনটি। জাতীয় নারী জোটের আহ্বায়ক আফরোজা হক, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সভাপতি রওশন আরা ও সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসু পৃথক বিবৃতিতে বলেন, আহমদ শফীকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, অন্যথায় তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এদিকে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এক বিবৃতিতে বলেন, ইসলামের কোথাও নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই। হেফাজতের আমির ধর্মের অপব্যাখ্যা করে ও মনগড়া ফতোয়া দিয়ে দেশ ও সমাজকে আলো থেকে অন্ধকারে নিতে চান। তাঁদের মতে, নারীশিক্ষাবিরোধী এই বক্তব্য সংবিধানবিরোধী, মৌলিক অধিকারবিরোধী, মানবাধিকারবিরোধী, নারী অধিকারবিরোধী, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী; এমনকি ইসলামবিরোধী।

আরও পড়ুন