দুই সপ্তাহের পরিচ্ছন্নতা অভিযানে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে গুলশান লেকপাড়ের। আগে সেখানে দুর্গন্ধে টেকা যেত না। বাসাবাড়ি ও স্থানীয় ভ্রাম্যমাণ দোকানের আবর্জনা ফেলা হতো। পুরো লেকপাড় ‘ভাগাড়ে’ পরিণত হয়েছিল। সেখানে এখন শোভা পাচ্ছে নানান প্রজাতির ফুলগাছ। পানির উৎকট গন্ধ কমেছে অনেকখানি।
লেকপাড়ের এমন বদলে যাওয়া পরিবেশ ইতিমধ্যে অনেক বাসিন্দার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সকাল-বিকেল বেড়াতে আসছেন গুলশান, নিকেতনের বাসিন্দারা। বেড়াতে এসে লেকের পাড়ে নতুন তৈরি করা বেঞ্চটিতে বসছেন, গল্প করছেন। কেউ কেউ আবার বসে শুধু নীরবে তাকিয়ে থাকছেন লেকের দিকে। যেন লেকের জলরাশির পানে তাকিয়ে কংক্রিটের শহরে প্রশান্তি খোঁজেন।
নোংরা লেকপাড়ের বদলে যাওয়ার গল্পটা শুরু ২২ মার্চ। গুলশান সোসাইটির উদ্যোগে সেদিন গুলশান-নিকেতন লেকের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু হয়। সবচেয়ে নোংরা অংশ ছিল নিকেতন সেতুসংলগ্ন লেকপাড় ও শাহজাদপুর সেতুসংলগ্ন লেকপাড়। ওই অংশ থেকেই শুরু হয় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম।
গুলশান সোসাইটি সূত্রে জানা গেছে, কার্যক্রমটির উদ্বোধনের পর থেকে ২০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিরবচ্ছিন্নভাবে লেকের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি গুলশানবাসী ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিজেদের সুবিধামতো এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন।
লেকপাড়ে ঘুরতে আসা কয়েকজন বলেন, নিকেতন সেতুসংলগ্ন লেকপাড়ে হাঁটা যেত না। ওই জায়গাটায় ছিল চা-সিগারেটের একাধিক দোকান। সবজি বিক্রেতারাও লেকের পাড় দখল করে রেখেছিলেন। দিন শেষে দোকানগুলোর আবর্জনা ফেলা হতো লেকে।
প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন, ককশিট, পুরোনো লেপ-তোশক, ভাঙারি পণ্য, বস্তাবন্দী বিভিন্ন বর্জ্য নিজেদের খেয়ালখুশিমতো ওই লেকের পানিতেই ফেলতেন সবাই।
গত শনিবার ওই জায়গায় গিয়ে দেখা যায়, ওই নোংরা অংশ পরিচ্ছন্ন করে লাগানো হয়েছে নানা জাতে ফুলগাছ। হেলান দিয়ে আরাম করে বসা যায়—এমন একাধিক বেঞ্চ বসানো হয়েছে লেকের পাড় ঘেঁষে। পাড়জুড়ে পড়ে থাকা ভাঙাচোরা ইট, সিমেন্ট, টাইলস ও সিরামিকের বিভিন্ন জিনিস পরিষ্কার করে ঝোপঝাড় কেটে ফেলা হয়েছে। বীজ ছিটিয়ে দেওয়ার পর সেখান গজাচ্ছে হালকা সবুজ ঘাস।
লেকের পানি থেকে তোলা হয়েছে ময়লা-আবর্জনা। পানিও এখন আগের থেকে পরিষ্কার ও দুর্গন্ধমুক্ত। সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য লাগানো ফুল ও পাতাবাহারের গাছগুলো দিন দিন সজীব ও সতেজ হচ্ছে।
লেকপাড়ের ফজলে রাব্বি পার্কে প্রায়ই বেড়াতে আসেন নিকেতনের বাসিন্দা মৌমিতা। শনিবার বিকেলে এসেছিলেন ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে। বদলে যাওয়া লেকপাড়ে কিছুক্ষণ বসে সময় কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, জায়গাটি অনেক বদলে গেছে। অনেক সুন্দর লাগছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কাঁচাবাজার আর অবৈধ দখলের কারণে আবর্জনা পচে দুর্গন্ধও ছড়াত চারদিক। এখন লেকপাড়ে গেলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। লেকপাড় পরিষ্কার হওয়ায় হাঁটার রাস্তায় মানুষের চলাচল বেড়েছে বলেও জানান ইকরাম হাসান। তিনি বলেন, আগে দুর্গন্ধ, নোংরা পরিবেশের কারণে অনেকেই লেকের পাড় দিয়ে হাঁটতেন না। এখন অনেকেই লেকপাড়ের রাস্তা ব্যবহার করছেন।
গুলশান সোসাইটির মহাসচিব শুক্লা সারওয়াত সিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, এই পদক্ষেপ কোনো সাময়িক চমক সৃষ্টির জন্য নয়। তাঁদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে পুরো গুলশান লেকে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হবে। তিনি বলেন, শুধু গুলশানের বাসিন্দারাই নয়, পাশাপাশি বারিধারা, বনানী, নিকেতন, বাড্ডা, শাহজাদপুর সব এলাকার (যারা সরাসরি লেকের সুবিধাভোগী) লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে ও সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে পরবর্তী সময়েও এটি যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করবে গুলশান সোসাইটি।
সোসাইটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, লেকটি অন্যান্য এলাকা জুড়ে থাকলেও গুলশান অংশেই আয়তন বেশি। তাই গুলশান সোসাইটিকে তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
রাজউক ও গুলশান সোসাইটির সমঝোতা চুক্তির ভিত্তিতে এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারত্বের দৃষ্টান্ত হিসেবে এই কাজ পরিচালিত হচ্ছে। লেকপাড়ের জায়গাগুলো অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত রাখতে প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতাও চেয়েছেন সোসাইটি।
রাজউকের গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক আমিনুর রহমান বলেন, ‘গুলশান লেক নিয়ে এলাকাবাসীর সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতায় আমাদের অভিজ্ঞতা খুব ভালো। সরকারি সেবা সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন পদক্ষেপের পরেও কাঙ্ক্ষিত সেবা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে পারে না। কারণ, উন্নয়নমূলক কাজের পরও এর রক্ষণাবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সফল হলে ভবিষ্যতে উত্তরা লেকেও একইভাবে ব্যবহারকারী অর্থাৎ উত্তরাবাসীর হাতে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হবে।