ঢাকায় অসহনীয় যানজট

আপাতত ভোগান্তিই ‘সমাধান’

যানজট সমস্যার সমাধানে বানানো হয়েছিল উড়ালসড়ক। সেখানেও নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে যানবাহন। একই চিত্র নিচের সড়কেও। তীব্র ভোগান্তিতে রাজধানীর বাসিন্দারা। গতকাল বিকেলে শান্তিনগর এলাকায়।
ছবি: সাজিদ হোসেন

ভুল পরিকল্পনার সঙ্গে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে রাজধানী ঢাকার তীব্র যানজট এখন অনেকটাই স্থায়ী রূপ নিয়েছে। এমন পরিস্থিতি বছরের পর বছর ধরে চললেও অবস্থার উন্নতির জন্য সরকারের পক্ষে যে ধরনের কার্যকর উদ্যোগ ও পরিকল্পনা থাকা দরকার, তাতেও ঘাটতি দেখছেন পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করেন, দীর্ঘ অনিয়ম–অব্যবস্থাপনার ফল হচ্ছে, যানজটে নিত্যদিন মানুষের ভোগান্তি। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলছেন, যানজট নিরসনে সরকার কাজ করছে, তবে সমাধানে সময় লাগবে।

ঢাকার যানজট কমাতে রুটিনমাফিক যেসব কাজ করার কথা সরকারের, সেটিও হচ্ছে না বলে মনে করে পরিবহন খাত নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখা, যত্রতত্র পার্কিং যাতে না হয় সেটি নিশ্চিতে পদক্ষেপ থাকা, ব্যক্তিগত গাড়ি নিরুৎসাহিত করে গণপরিবহন ব্যবহারে মানুষকে উৎসাহিত করা, ট্রাফিক আইন মেনে চলার বিষয়টি বাধ্য করা, এ ধরনের কাজও এখন ঠিকমতো হচ্ছে না। ‘অসহনীয় যানজট: সমাধান কী’ শীর্ষক সংলাপে পরিবহন বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপের আয়োজক ছিল ঢাকা ইউটিলিটি রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডুরা)।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ মো. সামছুল হক বলেন, ঢাকা শহরে ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা আছে। তার মধ্যে মাত্র আড়াই শতাংশ রাস্তা দিয়ে বাস চলতে পারে। ঢাকা শহরের যানজটের অন্যতম কারণ অপরিকল্পিতভাবে এই শহরের গড়ে ওঠা।

যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়া বড় বড় বিনিয়োগ করলেও প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাবে না বলেও মনে করেন সামছুল হক। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে সরকারের যে উদারতা রয়েছে, ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য স্বল্প সুদে ঋণ ও প্রকল্পে গাড়ি দেওয়া। এসব নিরুৎসাহিত করতে হবে। বিশ্বের যেসব শহর টেকসই উন্নয়ন পেয়েছে, সেখানে গণপরিবহনকে প্রাধান্য দিয়ে শহরটি গড়া হয়েছে। সামছুল হক বলেন, ব্যক্তিগত গাড়ি ও সিএনজিতে (অটোরিকশা) যাঁরা চলাচল করেন, তাঁরাও যেন গণপরিবহন ব্যবহারে আগ্রহী হন, সেই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা দরকার। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, জমি কম, জনসংখ্যা বেশি।

স্টেশনভিত্তিক নগরায়ণ গড়ার প্রস্তাব দিয়ে সামছুল হক বলেন, একটি মতিঝিল এলাকা নয়, অনেক মতিঝিল এলাকা গড়ে তুলতে হবে। স্টেশনের পাশে মতিঝিলের মতো নগর গড়তে হবে। স্টেশন হবে একটি নগর। নগরে থাকবে বহুতল অফিস ভবন। তার পেছনে থাকবে সেবা খাত। তার পেছনে থাকবে আবাসিক এলাকা। একজন মানুষ যে এলাকায় থাকবে, সে এলাকাতেই চাকরি করবে, তার ভ্রমণ ব্যয় থাকবে না। গাড়ি কিনতে হবে না।

উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংক ও বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সব৴শেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। অর্থাৎ দেড় দশকে ঢাকায় যানবাহন চলাচলের গড় গতি কমে গেছে ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটারের মতো। এআরআইয়ের হিসাবে এখন যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে যানজটে দিনে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা ক্ষতি হয়েছিল। তখন এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।

সমাধানের দায়িত্ব নেবে কে

যানজটের তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান আছে কি? এমন এক প্রশ্নে সংলাপে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ফুটপাতে দোকানপাট ও অবৈধ গাড়ি পার্কিং বন্ধ করতে পারলে কিছুটা হলেও যানজট থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে যাঁরা দায়িত্বে নিয়োজিত, তাঁদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু পুরো যানজট সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক কটি বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকার এ নিয়ে কাজ করছে, তবে সমাধানে সময় লাগবে।

স্ব স্ব অবস্থান থেকে সবাইকে দায়িত্ব পালন করতে বলে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন কি না, এমন এক প্রশ্নে মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘দায়িত্ব নিতে ভালোবাসি, যেটা আমার নেওয়া উচিত।’ যে দায়িত্ব মন্ত্রীর নয়, তা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বলেন, সে জন্য সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি, অনিয়ম ও দায়িত্বহীনতা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন মন্ত্রী। তিনি মনে করেন, ঢাকায় যে পরিমাণ রাস্তা রয়েছে, তা দিয়ে যানজট সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। রাস্তার পরিমাণ বাড়াতে হবে। রাস্তা বাড়াতে প্রয়োজনে বহুতল ভবন ভাঙতে হবে।

গতকাল সকালে সরকারি অফিস শুরুর সময়ে ঢাকায় তীব্র যানজট ছিল। যে কারণে অনুষ্ঠানে নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা পর হাজির হন সংলাপের অন্যতম আলোচক ও ‘নিরাপদ সড়ক চাই’–এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। অনুষ্ঠান শুরু হয় বেলা ১১টায়। তিনি হাজির হন দুপুর সাড়ে ১২টায়। অনুষ্ঠানস্থলে (সেগুনবাগিচায় ডিআরইউ কার্যালয়ে) ঢোকার আগে গাড়ি পার্ক করতে গিয়ে তাঁকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। পরে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘এখানে আমি গাড়িটা রাখব কোথায়? মন্ত্রী (তাজুল ইসলাম) সাহেবও তো রাস্তার ওপরে গাড়ি রেখে এখানে চলে এসেছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবে গাড়ি রাখার জায়গা আছে। সেখানে যেতে পারি না। কারণ, সচিবালয়ের কর্মকর্তারা গাড়ি দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে রাখেন। এগুলো তো বন্ধ করতে হবে।’

এখনো ঢাকা শহরে যত গাড়ি ও মানুষ আছে, যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করা গেলে স্বস্তির সঙ্গে মানুষ চলাচল করতে পারবেন বলে মনে করেন ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বলেন, ঢাকা শহরকে যানজটমুক্ত করা সম্ভব। এ জন্য কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু দায়িত্ব তো কেউ নিচ্ছেন না।

ব্যক্তিগত গাড়ি কমানোর পরামর্শ

৭টি মন্ত্রণালয় ও ৫৪টি প্রতিষ্ঠান ঢাকা শহরের সেবা করতে গিয়ে জনগণের গলা কাটছে বলে সংলাপে উল্লেখ করেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। তিনি বলেন, ঢাকায় সেবাদানকারী সব প্রতিষ্ঠানকে এক ছাতার নিচে আনতে হবে। ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের ওপরে জনগণের প্রতিনিধিকে নিয়ে আসতে হবে। একজনকে নেতৃত্ব দিতে হবে। সরকারপ্রধান যেমন প্রধানমন্ত্রী, তেমনি ঢাকা শহরের প্রধান হবেন মেয়র। এই মেয়রকে সঠিক জায়গায় সঠিকভাবে বসাতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান করা যাবে।

যানজট কমানোর উদ্দেশ্যে স্থপতিদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠক করেছিলেন বলেও সংলাপে জানান মোবাশ্বের হোসেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী যে চিন্তা তুলে ধরেছিলেন, তা উল্লেখ করে মোবাশ্বর হোসেন বলেন, গ্রিন রোডে ১১৪ জন সচিব ও যুগ্ম সচিবের জন্য আবাসিক এলাকা করা হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিদিন সকাল ৯টায় তাঁরা প্রত্যেকে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হন। তাঁদের মানসম্মত দুটি বড় বাস অথবা চারটি মাইক্রোবাসে করে সচিবালয়ে নিয়ে এলে ১১৪টি গাড়ির চাপ থেকে রাস্তা মুক্ত হবে। এভাবে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি কমিয়ে আনার প্রতি গুরুত্ব দেন এই স্থপতি।

ঢাকায় গত এক দশকে বাস-মিনিবাসের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল বেড়েছে অনেক বেশি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে রাজধানীতে মোটরসাইকেল বেড়েছে প্রায় ৮ গুণ। সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ লাখে। একই সময়ে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বর্তমানে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৮০৯টি, যা ২০১০ সালে ছিল ১ লাখ ৭৮ হাজার।

যানজট নিরসনে এই মুহূর্তে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে পরামর্শ দেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম। তিনি অবৈধ পার্কিং বন্ধ ও ফুটপাত দখলমুক্ত করার কাজ শুরু করতে বলেন।

সড়কে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হলে অর্ধেক যানজট এমনিতে কমবে বলে মনে করেন ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত।

সংলাপের সভাপতিত্ব করেন ডুরার সভাপতি মো. রুহুল আমিন। সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক শাহেদ শফিক। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ আসাদ রহমান মোল্লা।

অনুষ্ঠানে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, ‘ঢাকা শহরে যানজট কমার লক্ষণ দেখি না। আগামী ২০ বছরেও যদি কমে, তাতেই আমরা খুশি।’