আঁতুড়ঘরে মরল না মশা

মশার প্রজননক্ষেত্রের পানিতে ওষুধ ডুবিয়ে রেখেছিল ডিএনসিসি। উদ্দেশ্য ছিল লার্ভা নষ্ট করে মশার বংশ বৃদ্ধি ঠেকানো। কিন্তু সেই ওষুধ কাজ করেনি।

কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সমন্বিত মশকনিধন কর্মসূচিতে দিনের বেলায় পরিপক্ব মশা নিধনের ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে। যদিও এই সময়ে কিউলেক্স মশারা ঝোপঝাড়ে থাকে। গতকাল সকাল নয়টার দিকে মিরপুরে সাগুফতা খাল এলাকায়

আঁতুড়ঘরেই মশা মেরে ফেলার চেষ্টায় সফল হতে পারল না ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। মশার চিহ্নিত বড় বড় প্রজননক্ষেত্রের পানিতে সাড়ে চার মাস আগে ওষুধ ডুবিয়ে রেখেছিল ডিএনসিসি। উদ্দেশ্য ছিল, পানিতে থাকা লার্ভা নষ্ট করে মশার বংশ বৃদ্ধি ঠেকানো। ডুবন্ত সেই ওষুধ কাজ করলে এখন মশা থাকত কম। শান্তিতে থাকত নগরবাসীর। কিন্তু মানুষ বলছে, তারা এখন মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ।

নোভালুরন নামের বিশেষ ওই ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা ও কীটতত্ত্ব বিভাগের দুই শিক্ষক। অবশ্য ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত করে বলেছে, ঠিক জায়গায়, ঠিক মাত্রায় ব্যবহার না করায় ওষুধের উপকার পাওয়া যায়নি। সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এই দুই পক্ষের সঙ্গে পুরোপুরি একমত না হলেও ওষুধে আশানুরূপ ফল না পাওয়ার কথা মোটামুটি স্বীকার করেছেন।

গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিএনসিসি কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে ট্যাবলেট বা বড়ির মতো দেখতে নোভালুরন ওষুধ ব্যবহার শুরু করে। মশার প্রজনন ও বংশবিস্তারের জন্য উপযোগী এমন ৬২৯টি স্থান চিহ্নিত করে ওষুধ ব্যবহার করেছিল বলে জানায় সিটি করপোরেশন। এই সব কটি স্থানের তালিকা না দিলেও গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুরের মতো এলাকায় লেক, খালসহ বিভিন্ন জলাশয়ে ওষুধ ব্যবহারের তথ্য নিশ্চিত করেছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এই এলাকাগুলোই এবার শহরের অন্যতম মশাপ্রবণ এলাকা হিসেবে আলোচিত।

গতকাল সোমবার উত্তর সিটি এলাকায় চিরাচরিত মশকনিধন কার্যক্রম শুরু করেছে ডিএনসিসি। ১০ অঞ্চলে একযোগে লার্ভা ও মশা নিধনের এই কার্যক্রম অন্তত ১০ দিন চলবে বলে ঘোষণা করেছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম।

পানিতে নোভালুরন প্রয়োগ

ডিএনসিসির স্বাস্থ্য ও ভান্ডার বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে ইংল্যান্ড থেকে ৪৫ লাখ ৫ হাজার ৫৪৪ টাকা ব্যয়ে ৪৮০ কেজি নোভালুরন ওষুধ কেনা হয়। এ পর্যন্ত ২৫০ কেজি ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে। ইংল্যান্ডে রাসেল আইপিএম নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ওষুধ কেনা হয়। দরপত্রের মাধ্যমে ডিএনসিসিকে এই ওষুধ সরবরাহ করে ট্যাক ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিটি নোভালুরন বড়ি এক গ্রাম ওজনের এবং একেকটি ১০ লিটার পানিতে কাজ করবে।

ওষুধটি প্রয়োগের সময় ডিএনসিসির উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, লার্ভা থেকে পরিণত মশা হওয়ার এই সময়টায় লার্ভার ওপরের আবরণকে (চিটিন) ক্ষতিগ্রস্ত করবে এই ওষুধ। তাতে মশা খোলস বদলাতে পারবে না। তখন লার্ভা ধ্বংস হয়ে যাবে। মশার জন্ম হবে না। শুরুর দিন থেকেই ওষুধটি উত্তরা ১১ ও ১২ নম্বর সেক্টর-সংলগ্ন লেকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে তখন জানিয়েছিলেন তিনি।

তবে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরিফ সান্তু দুই দিন আগে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই রকম মশা আগে কেউ কখনো দেখেছে বলে শুনিনি। এরা এমনভাবে জেঁকে ধরে ভয় পেয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।’

উত্তরা ১১ ও ১২ নম্বর পার্কগুলো সন্ধ্যার পর সব সময় মুখর থাকত স্থানীয়দের পদচারণে। গত পরশু সরেজমিনে দেখা গেল, সেই পার্কগুলো ফাঁকা। বাসিন্দারা বলেছেন, মশার যন্ত্রণায় পার্কে আসা ছেড়ে দিয়েছেন তাঁরা। সন্ধ্যার পর বাসার ভেতর কয়েল ও স্প্রে ব্যবহার করার পরও হাতে মশা মারার ব্যাট রাখতে হচ্ছে।

কেন কাজ করল না নোভালুরন?

ডিএনসিসির ব্যবস্থাপনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাহমিনা আক্তারের তত্ত্বাবধানে তিন মাসব্যাপী নোভালুরন ওষুধের পরীক্ষা চালানো হয়। তখন বলা হয়েছিল, যেসব প্রাণীর দেহে ‘কাইটিন’ নামের উপাদান রয়েছে, শুধু সেসব প্রাণীর লার্ভার বৃদ্ধি ঠেকিয়ে দিতে পারে এই ওষুধ। মশার লার্ভায় কাইটিন থাকায় নোভালুরন তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে মশার জন্ম রোধ করতে সক্ষম। ওষুধটি পানিতে প্রায় ৯০ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে বলেও তখন জানানো হয়েছিল।

এ হিসাবে এখন নগরে কিউলেক্স মশার উপদ্রব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী ও উত্তরা থেকে শুরু করে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, খিলক্ষেত, এমনকি ঢাকার পূর্বাঞ্চলে সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত বেরাইদ, ডুমনি, উত্তরখান, দক্ষিণখান—সর্বত্র বাসিন্দারা এখন মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। নগরবাসীর অনেকেই মশার এই উপদ্রবকে স্মরণকালের সর্বোচ্চ বলে মন্তব্য করেছেন।

গুলশান সোসাইটির মহাসচিব শুক্লা সারাওয়াত প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা তো অধিক শোকে পাথর হওয়ার মতো অবস্থা। আমার বয়সকালে এবারের মতো মশার আক্রমণ আর দেখিনি। যেন মশার কাছে মানুষের পরাজয়।’ গুলশান লেকে নোভালুরন ওষুধ ব্যবহারের বিষয়টি তিনি জানতেন না বলে জানান প্রথম আলোকে।

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাহমিনা আক্তার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ওষুধটি যখন পরীক্ষা করে দিয়েছিলাম, তখনই সিটি করপোরেশনকে বলেছিলাম, এই ওষুধের ফরমুলেশন যেভাবে করা, তাতে এটা আমাদের প্রেক্ষাপটে ব্যবহারোপযোগী নয়। কারণ, পানিতে দেওয়ামাত্র ওষুধ পানির নিচে চলে যাচ্ছে। ওষুধ যদি ভাসমান থাকত বা ভাসমান রাখার ব্যবস্থা করে আনা যেত, তাহলে বদ্ধ ডোবা কিংবা জলাশয়ে ব্যবহার করে হয়তো সুফল মিলত।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশারও প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিএনসিসি যখন নোভালুরন ব্যবহার শুরু করে, তখনই আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছি, এটা কাজ করবে না। শুরু থেকেই আমি এই ওষুধের বিপক্ষে থাকায় ডিএনসিসির অনেক কর্মকর্তা আমার ওপর বিরক্তও ছিলেন। এখন কী হলো? প্রমাণিত হলো ওষুধটি কাজ করেনি। ওষুধ কাজ করলে এই সময়ে এত মশা থাকত না।’

অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘নোভালুরন ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়ে কাজ করে। কিন্তু আমাদের ডোবা-জলাশয়গুলো আয়তনে বেশ বড় এবং এগুলোতে এত বেশি দূষণ যে সেখানে ওষুধটি সর্বত্র ছড়াতে পারবে না। পানিতে প্রচুর ময়লা থাকার কারণে ওষুধের ছড়িয়ে পড়া বাধাপ্রাপ্ত হবে। তখন কাজ হবে না। এ জন্য দেশের আবহাওয়া ও পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পণ্য বাছাই করতে হয়।

অবশ্য ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, নোভালুরন ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছুটা কমতি ছিল। তবে ওষুধটি কার্যকর বলেই পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনিও বলেন, সব নালা-নর্দমা নোভালুরন ব্যবহারের উপযোগী নয়। এরপরও যেখানে যেখানে সম্ভব, এর ব্যবহার হয়েছে এবং কিছু উপকার পাওয়া গেছে।

নোভালুরন ওষুধটি যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুরে ব্যবহৃত হয় বলে জানান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টেক ইন্টারন্যাশনালের সমন্বয়ক তানভীর আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে জানান, তিন মাস পর্যবেক্ষণের পর নোভালুরনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা আইইডিসিআর এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পৃথকভাবে ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করেছে। গবেষণাগার ও মাঠপর্যায় ওষুধটি শতভাগ কার্যকর হওয়ার পরই ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওষুধটি সরাসরি ইংল্যান্ডে প্রস্তুত করা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তানভীর আহমেদ বলেন, ওষুধটি ভাসমান হলে এক জায়গায় থাকবে না। ভেসে ভেসে সব ওষুধ হয়তো এক জায়গায় জড়ো হয়ে যাবে। তখন কী হবে? তিনি দাবি করেন, নোভালুরন পরিষ্কার পানি থেকে সর্বোচ্চ নোংরা পানিতেও কার্যকর। তাহলে নগরে মশার এত উৎপাত কেন, জানতে চাইলে এই সরবরাহকারী বলেন, ওষুধ যতটুকু ব্যবহার করার প্রয়োজন ছিল, যেখানে ব্যবহার করা উচিত ছিল, সিটি করপোরেশন সঠিকভাবে তা করতে পারেনি বলেই মনে হচ্ছে। ওষুধ সঠিকভাবে প্রয়োগ না করলে সুফল পাওয়া যাবে না।

এ বিষয়ে ডিএনসিসির মেয়রের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। নোভালুরন কার্যকারিতা ভালো জানিয়ে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের কীটতত্ত্ববিদদের পরামর্শেই ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়েছে। ভিন্নমত থাকতে পারে। কিন্তু ওষুধ কাজ করছে না—এমনটা মনে করছি না।’

কীটতত্ত্ববিদ ও ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ভাষ্যের বিষয়ে করপোরেশনের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, ‘কারও মতামতকে অবজ্ঞা করছি না। তবে সিটি করপোরেশন যেহেতু এ বিষয়ে কাজ করে আসছে, তাই বিষয়টিতে করপোরেশনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যথেষ্ট হয়েছে।’ তিনি জানান, ওষুধটি যাতে পানির নিচে তলিয়ে না যায় বা ভেসে অন্যত্র চলে না যায়, সে জন্য এটিকে মশারির কাপড় পেঁচিয়ে বাঁশের কঞ্চিতে বেঁধে পানিতে রেখে দেওয়া হয়েছিল।