বিরাট এক অফিসে বসে আছে নোমান। অফিসটা তার নিজের। সাংবাদিকেরা তার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছে। নিজের গল্পটা সে সাংবাদিকদের বলবে। তার বড় হওয়া গল্পটি আসলে নিজের একটা আইডেনটিটি তৈরি করার গল্প। ফ্লাশব্যাকে গল্পটা চলে।
নোমান একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। তখন থেকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে মহিলা কলেজের একটি মেয়েকে ভালোবাসে। মেয়েটার নাম স্বর্ণা। নোমান মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। স্বর্ণারা অভিজাত শ্রেণির। স্বর্ণার মা-বাবার আলাদা পরিচয় আছে সমাজে, সম্মান আছে।
দিন যায়, স্বর্ণা আর নোমানের প্রেমের বয়স প্রায় তিন বছর। স্বর্ণা জানে, নোমানের খুব কষ্ট করে চলতে হয় ঢাকায়। নোমানকে তার পরিবারও চালাতে হয়। এ জন্য সে চাইলেই অনেক কিছু বলতে পারে না।
নোমান তার পরিবারকে ভালোবাসে, একটা ছোট বোনও আছে। নিজের খরচের পাশাপাশি পরিবারেও কিছু কন্ট্রিবিউট করা লাগে।
হঠাৎ একদিন বিকেলে স্বর্ণা নোমানকে বলল, আচ্ছা, বাসা থেকে ছেলে দেখছে। দেখো না, কিছু করতে পার কি না? নোমান বলল, একটা চাকরি পেলে আর বাবা একটু সুস্থ হলেই কিছু করা যেত। একটু ধৈর্য ধর। স্বর্ণা ধৈর্য ধরে। তারপর কেটে গেল আরও দুটি মাস।
দুই মাস পর নোমানকে আবার স্বর্ণা বলল, একটু দেখো না, বাবা তো চাপ দিচ্ছে আমার বিয়ের জন্য। নোমান তখনও বলল, আচ্ছা, আমি দেখছি। আর কয়েকটা দিন।
স্বর্ণা বুঝতে পারছে যে নোমান নিরুপায়। ওর করার কিছুই নেই। কিন্তু স্বর্ণা তার ভালোবাসার মানুষটিকে হারাতে চায় না। ভয়ে ভয়ে মা-বাবাকে বলেই দেয়, সে নোমানকে ভালোবাসে।
বাবা খোকা সাহেব তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে নোমানের পরিচয় পেয়ে। আর বললেন, ‘অসম্ভব, সমাজে আমাদের একটা নাম আছে। আর আমি একটা বেকার চালচুলোহীন পরিবারের ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিব নাকি? এই ছেলের তো কোনো আইডেনটিটিন নেই। আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখানো যাবে না।’
হঠাৎ একদিন নোমানের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। নোমান চলে যায় তার গ্রামের বাড়ি। হাসপাতালে অনেক টাকা লাগবে। কিন্তু বসতবাড়ি ছাড়া তাদের আর কোনো সম্পত্তি নেই। অনেকগুলো মেডিকেল টেস্ট করাতে হবে। হাতেও খুব একটা টাকা নেই। শেষ পর্যন্ত টিউশনির টাকা জমিয়ে কেনা স্মার্টফোনটা বেচে দেয় নোমান। সেই টাকা দিয়ে বাবার টেস্ট করায়। বাড়িটা না বেচলেও বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়, বন্ধকের টাকায় চলে বাবার চিকিৎসা।
এদিকে স্বর্ণার বিয়ে। স্বর্ণা নোমানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না ফোনে, ফোন বন্ধ বলছে। এদিকে বাবার অসুস্থতার বিষয়টা জানাতে নোমানও বন্ধুর ফোন থেকে ফোন করে স্বর্ণাকে। কিন্তু ততক্ষণে স্বর্ণার ফোনটা নিয়ে নিয়েছেন খোকা সাহেব। নোমান আর যোগাযোগ করতে পারে না।
এরপর মারা যান নোমানের বাবা, প্রায় বিনা চিকিৎসায়। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায় নোমান।
এদিকে স্বর্ণার বিয়ের আয়োজন শুরু হয়েছে। কিন্তু নোমান ছাড়া কাউকে বর হিসেবে মানতে পারবে না স্বর্ণা। তাই সুইসাইড করে সে।
বাবার মৃত্যুর সপ্তাহখানেক পর ঢাকা চলে আসে নোমান। পরিচিত সব জায়গায় স্বর্ণাকে খুঁজতে থাকে সে, চেনা লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে। কোনো খবর না পেয়ে শেষ পর্যন্ত চলে যায় স্বর্ণার বাসায়। দেখে, বাসার বারান্দায় বসে স্বর্ণার মা কাঁদছে। নোমান ভাঙা ভাঙা গলায় জিজ্ঞাসা করে, ‘স্বর্ণা নেই?’
কান্না চোখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কে?’
‘আন্টি, আমি নোমান।’
কাঁদতে কাঁদতে স্বর্ণার মা বলল, ‘ও তো তোমাকে ভালোবাসত। ওকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারলে না? তাহলে অন্তত আমার মেয়েটা বেঁচে থাকত।’
নোমানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সে পাগলের মতো ঘুরে বেড়ায়।
একদিন সন্ধ্যায় আনমনা হয়ে সে রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। পাশ থেকে তার হাত ধরে স্বর্ণা। সাদা একটা সালোয়ার–কামিজ পরা সে। নোমান তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কেন চলে গেলে আমাকে ছেড়ে? এর জন্য আমি দায়ী।’
স্বর্ণা বলল, ‘না এর জন্য আমি দায়ী। কিন্তু তুমি এভাবে নিজেকে ধ্বংস কোরো না। তুমি সমাজে এমন মানুষের পাশে দাঁড়াও, যারা শুধু নিজের একটা আইডেনটিটির অভাবে তাদের ভালোবাসাকে হারাচ্ছে। বাবা-মাকে বাঁচাতে পারছে না। তাহলে দেখবে আমি শান্তি পাচ্ছি।’ বলেই উধাও সে।
তারপর নোমান নিজেকে গড়ে তোলে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে এবং সমাজের আইডেনটিটিহীন শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েদের চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় তার প্রতিষ্ঠানে।