দিনে দিনে পেরিয়ে গেল প্রথম আলোর পথচলার আড়াই দশকেরও বেশি সময়। এই পথপরিক্রমার ২৬তম বার্ষিকীতে সুহৃদ, শুভাকাঙ্ক্ষী, প্রিয়জনদের নিয়ে এক প্রীতিময় সম্মিলনীর আয়োজন করে প্রথম আলো। আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর হোটেল র্যাডিসন ব্লু মিলনায়তনে ছিল এই আয়োজন। বরাবরই বর্ষপূর্তিতে প্রিয়জনদের সান্নিধ্য লাভের এমন আয়োজন হয়ে থাকে। তবে এবার আয়োজনের মূল সুরটি ভিন্নতর।
দেশে সদ্যই এক বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বহু তরুণ তাজা প্রাণ, বহু আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বৈরশাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সমাজে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর জনমানসে জেগেছে বৈষম্যহীন, মুক্ত, মানবিক, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। সে কারণে এবার প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সব আয়োজনের ভাবনার কেন্দ্রে ছিল এই গণ-অভ্যুত্থান। প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয় ‘জেগেছে বাংলাদেশ’। তাই আজকের প্রীতিসমাবেশের মূল সুরটিও ছিল ছাত্র–জনতার সফল গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে।
নির্ধারিত সময় মেনে সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। তবে অতিথিদের আগমন শুরু হয় আরও ঘণ্টাখানেক আগে। তাঁরা প্রারম্ভিক সময়টুকু উপভোগ করেছেন ছবি তুলে, নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতার ফাঁকে হালকা খাবার ও কোমল পানীয়তে চুমুক দিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, নারীনেত্রী, শিল্প-সাহিত্যের গুণীজন, পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, আইনবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি—সবাই এসেছিলেন অতিথি হয়ে।
আমন্ত্রিত অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বরা আজ এখানে সমবেত হয়েছেন। আপনাদের উপস্থিতিতে আমরা অনুপ্রাণিত।’ তিনি অতিথিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা জানান। বলেন, ‘গত ২৬ বছরে আমরা একনিষ্ঠভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিশ্রুতি রক্ষার চেষ্টা করেছি। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময়ও তা অব্যাহত ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।’
এরপর জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকতার পর্ব শুরু হয়।
মিলনায়তনের উভয় পাশের দেয়াল ও মঞ্চের দুই পাশে স্থাপন করা হয়েছিল বড় আকারের এলইডি পর্দা। স্বাগত পর্বের পর সেখানে প্রদর্শন করা হয় প্রামাণ্যচিত্র ‘বিদ্রোহে বিপ্লবে’।
‘আমার ভাই কবরে/খুনি কেন গদিতে’, ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’ এমন বজ্রনির্ঘোষ স্লোগান ভেসে আসে নেপথ্য থেকে। পর্দায় ভেসে ওঠে রংপুরের সেই আবু সাঈদের ছবি। যেন অগণিত কণ্ঠের ওই স্লোগানকে বাস্তবে পরিণত করতেই তিনি বুক টান করে দাঁড়িয়েছেন পুলিশের উদ্যত বন্দুকের সামনে। তারপর মুহুর্মুহু গুলির শব্দ! কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন সাঈদ। কিন্তু পালানোর কথা ভাবেননি। কী অসীম সাহস! কী অনন্য বীরত্বে শেষ শক্তিটুকু একত্র করে অটল দাঁড়িয়ে রইলেন নিজের পায়ের ওপর! মৃত্যুর আগের মুহূর্ত অবধি। পরদিন তিনি ছবি হয়ে এলেন প্রথম আলোর প্রথম পাতায়। রক্তের বন্যা তখন বয়ে যাচ্ছে সারা বাংলায়। আন্দোলনকারীদের দমাতে বৃষ্টির মতো গুলি চলছে পুলিশের। গেন্ডারিয়ার কিশোর আনাস মায়ের কাছে চিঠি লিখে ঘর থেকে বের হয়ে মিছিলে গিয়েছিল। ফিরেছে লাশ হয়ে। জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত তার মরদেহ খাটিয়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত। তার মা সানজিদা খান বলছিলেন, ‘আমরা ঘরে বসে স্লোগান দিতাম রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়। সেই রক্ত যে আমার সন্তানের রক্তে মিশে যাবে, তাতে ভাবি নাই।’ ...চোখ ভেসে যাওয়া সেই দৃশ্য।
প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয় প্রতিদিনের আন্দোলন, হত্যা, নিপীড়নের সঙ্গে প্রথম আলোর পথচলা। ছাপা পত্রিকা ও অনলাইনের শিরোনাম ধরে ধরে দেখানো হয়েছে কেমন করে প্রতিটি ঘটনার বিবরণ, নিহতের সংখ্যা বিভিন্ন উৎস থেকে বারবার যাচাই করে প্রকাশ করা হয়েছে। সাংবাদিক, আলোকচিত্রীরা কতটা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। এমনকি গুলিতে আহত হয়েছেন। এসব উঠে আসে প্রামাণ্যচিত্রের বিভিন্ন পর্যায়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, রাজধানীসহ সারা দেশে ফুঁসে ওঠা ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ, রাজপথে পড়ে থাকা মৃতদেহ, হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া, পুলিশের বেদম মারপিট, গণগ্রেপ্তার, রাজপথে সাঁজোয়া যানবাহনের দৃশ্যগুলো পর্দায় ভেসে আসতে থাকে একের পর এক। দেখা যায়, অভ্যুত্থানে প্রেরণা দেওয়া গান ও আবৃত্তি। সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে সব স্তরের মানুষের রাজপথে নেমে আসা জনজোয়ারের দৃশ্য।
একপর্যায়ে কারফিউ ও দেখামাত্র গুলির নির্দেশ আসে সরকার থেকে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন তাঁর কী অপরাধ? কেন তিনি পদত্যাগ করবেন? তিনি পালাবেন না বলে ঘোষণা করেন, ‘শেখ হাসিনা পালায় না।’ এর পরপরই দেখা যায় প্রবল বিক্ষোভের মুখে তিনি হেলিকপ্টারে উঠে পালিয়ে যান। উল্লাসে ফেটে পড়েন জনতা।
গণ-অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলো এবং অভ্যুত্থানকালে প্রথম আলোর সাংবাদিকতা অবলম্বন করে এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন রেদোয়ান রনি।
আগেই বলা হয়েছে, এবার প্রথম আলোর বর্ষপূর্তির যাবতীয় আয়োজনের ভাবনার কেন্দ্রে ছিল গণ–অভ্যুত্থান। গণ-অভ্যুত্থানের সময় প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিকদের তোলা নির্বাচিত ছবি নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে ‘মুক্ত করো ভয়’ নামে ফটো জার্নাল। এ ছাড়া দেশের প্রখ্যাত শিল্পী শহীদ কবির অভ্যুত্থানের প্রতীক শহীদ আবু সাঈদকে নিয়ে ‘চির উন্নত মম শির’ নামে একটি ছাপচিত্র করেছেন। শিল্পী শহীদ কবির ও ফটো জার্নালের গ্রাফিক ডিজাইনার মাহবুবুর রহমান মঞ্চে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্পকর্ম ও বইটি দর্শকদের সামনে তুলে ধরেন। পরে এই শিল্পকর্ম ও বই উপহার দেওয়া হয় অতিথিদের।
আর ছিল প্রথম আলোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মিডিয়াস্টার লিমিটেড ও ট্রান্সকম গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নামে চালু করা বর্ষসেরা সাংবাদিকতার পুরস্কার প্রদান। লতিফুর রহমানের কথা প্রথম আলো গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে সব সময়। প্রতিবছর প্রথম আলোর সেরা সাংবাদিককে দেওয়া হয় লতিফুর রহমান পুরস্কার। এবার এই পুরস্কার পেয়েছেন প্রথম আলোর উপসম্পাদক এ কে এম জাকারিয়া। ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান ও প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
অনুষ্ঠান শেষ হয় গানে গানে। গানটিও জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানকে নিয়ে। তরুণ শিক্ষার্থী ও শিল্পী পারশা মেহজাবিনের লেখা-সুর করা ও গাওয়া ‘ভুলে যাই আমি ভুলে যাও তুমি ভুলে/ যাক পুরো জাতি/ কীভাবে মানুষ মরেছে অকালে কীভাবে/ কেটেছে রাতি/ আমি ভুলে যাই কীভাবে বুলেট ছিদ্র/ করেছে মুগ্ধকে/ তুমি ভুলে যাও আবু সাঈদের বিশ্বাস ভরা বুকটাকে...’ গানটি গণ-অভ্যুত্থানের সময় জুগিয়েছিল অনুপ্রেরণা। মঞ্চে এসে সেই গানই অতিথিদের গেয়ে শোনালেন পারশা মেহজাবিন।
পারশা তাঁর গানে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন এত বিপুল মানুষের এই আত্মত্যাগ কি জাতি ভুলে যাবে? নিশ্চয়ই এত প্রাণ, এত রক্ত, অশ্রু এ জাতি ভুলবে না। সঞ্চিত থাকবে জনতার সম্মিলিত স্মৃতিতে। সাহস, উদ্যম প্রেরণা জোগাবে যুগ–যুগান্তরে। এই আশাবাদ নিয়েই শেষ হয়েছিল শীতের স্পর্শ লাগা হেমন্ত–সন্ধ্যায় প্রীতিতে উষ্ণ এই আয়োজন।