জীবাশ্ম জ্বালানি নয়, প্রয়োজন নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি

প্রথম আলো ডটকম আয়োজিত ‘জলবায়ু ও জ্বালানি সুরক্ষা: তরুণদের ভাবনা ও প্রত্যাশা’ শিরোনামে অনলাইন আলোচনা
ছবি: প্রথম আলো


জলবায়ু সুরক্ষা ও দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানিনিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে অন্যদের মতো উদ্বিগ্ন দেশের তরুণেরাও। তাঁরা জলবায়ু ও জ্বালানি সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ দেখতে চান। সম্প্রতি প্রথম আলো ডটকম আয়োজিত ‘জলবায়ু ও জ্বালানি সুরক্ষা: তরুণদের ভাবনা ও প্রত্যাশা’ শিরোনামে অনলাইন আলোচনায় এসব কথা বলেন তরুণ জলবায়ুকর্মীরা। প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেনের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন তরুণ জলবায়ুকর্মী এবং ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের কর্মকর্তা সোহানুর রহমান, শাকিলা আক্তার ও এস জেড অপু।

আলোচনার শুরুতেই শওকত হোসেন বলেন, ‘জলবায়ু ও জ্বালানি সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা তরুণদের ভাবনা ও প্রত্যাশার কথা জানতে চাই। তাঁরা কেন জলবায়ু কিংবা জ্বালানির মতো কঠিন বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। আর তাঁদের উদ্বেগের জায়গাটা কোথায়?’

সঞ্চালকের প্রশ্নের উত্তরে দীর্ঘদিন এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা সোহানুর রহমান বলেন, ‘আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আমাদের জন্য এখন অস্তিত্বের সংকট। বর্তমান প্রজন্মের জন্য যেমন, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও। আমরা যদি এখনই এই সংকটের সমাধান করতে না পারি, তাহলে পৃথিবী আমাদের জন্য আর বাসযোগ্য থাকবে না।’ তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম মাস এ বছরের আগস্টের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা হিটওয়েভ দেখেছি, সেই সময় একই সঙ্গে বিদ্যুৎ-সংকটও ছিল।’

সংকট সমাধানের উপায় সম্পর্কে সোহানুর বলেন, ‘দেখুন, আমরা কিন্তু এখনো বিদ্যুৎ উৎপাদনে ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানিতেই সিংহভাগ নির্ভর করছি। কিন্তু জলবায়ু ও সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে হলে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানি নয়, বরং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিতে হবে। এটা ঠিক, বাংলাদেশও উন্নত হচ্ছে, অর্থনীতিও এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের জলবায়ু-সংকট আছে। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতি, ডলার এবং সম্প্রতি বিদ্যুৎ-সংকটও যোগ হয়েছে। আর জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে আমাদের আবার হাজার কোটি টাকা গচ্চাও যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতেও।’

শাকিলা আক্তার

জলবায়ু এবং জ্বালানি-সংকট কি তাহলে বর্তমান প্রজন্মের জন্য চিন্তার বিষয় নাকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য? শওকত হোসেনের এই প্রশ্নের উত্তরে শাকিলা বলেন, ‘আমরা আসলে বর্তমান নিয়েই বেশি চিন্তিত। কারণ, এই যে জীবাশ্ম জ্বালানিতে আমাদের এখনো নির্ভরতা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা—সব মিলিয়ে আমাদের একটা জায়গায় যেতে হবে।’

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা এগোচ্ছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার, মোংলা ও গাইবান্ধাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে।’

কর্মসংস্থান বিবেচনায় একজন তরুণ হিসেবে আপনার উদ্বেগের জায়গা কোথায়? সঞ্চালকের প্রশ্নের জবাবে ইয়ুথনেটের ইভেন্ট কো-অর্ডিনেটর এস জেড অপু বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। আর দেশের অধিকাংশই তরুণ এবং তরুণদের কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে সেটা অনেকটাই নির্ভর করে তরুণদের কর্মসংস্থানের ওপর।’

অপু আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে ঢুকছেন। এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গুরুত্ব দেওয়া হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক একটা শিল্প গড়ে উঠবে। সে ক্ষেত্রে তরুণদের এ শিল্পের বিভিন্ন শাখায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আবার যাঁরা কারিগরি বোর্ড থেকে পাস করছেন, তাঁদের জন্যও চাকরির সুযোগ হবে।’ সবশেষে তিনি এনার্জি ট্রানজিশনে কীভাবে চাকরিরতদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, সেটাও উল্লেখ করেন।

সোহানুর রহমান

অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে সঞ্চালক শওকত হোসেন আবারও সোহানুর রহমানের কাছে জানতে চান, কীভাবে তাঁর মতো তরুণ জলবায়ুকর্মীরা জীবাশ্ম জ্বালানির আমদানি কমানো এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির গুরুত্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অ্যাডভোকেসির কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাবেন? কারণ, পরিস্থিতি তো আবার পাল্টাতে পারে, যুদ্ধ থেমে যেতে পারে, সঙ্গে ডলার-সংকটও কেটে যেতে পারে…।’

উত্তরে সোহানুর রহমান বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব কিন্তু আমাদের দেশেও পড়েছে। এখন আমরা যদি বাইরের দেশের ওপর নির্ভর না করে জ্বালানি সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি একটা ভালো উপায়। আবার জলবায়ু-সংকটের কথাও এখন সবাই টের পাচ্ছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামে দুবার বিশ্বনেতা হিসেবে কাজ করেছেন। আর বাংলাদেশের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণ কমানোরও লক্ষ্য রয়েছে।’
নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণার সূত্র উল্লেখ করে সোহানুর বলেন, ‘বাংলাদেশ যদি সোলার এনার্জিতে বিনিয়োগ করে, তাহলে বছরে এক বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় সম্ভব। আমাদের সরকারও বিষয়টি বুঝতে পেরেছে এবং মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনাতে ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।’

এস জেড অপু

এবার সঞ্চালক এস জেড অপুর কাছে জানতে চান, জলবায়ু নিয়ে সরকারের যে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগগুলো রয়েছে, সেগুলোর সমন্বয় কীভাবে হওয়া উচিত? অপু বলেন, ‘বাংলাদেশে পলিসির বেড়াজাল রয়েছে, আবার দাপ্তরিক কাজেও সময় বেশি দিতে হয়। মন্ত্রণালয়গুলোরও সমন্বয়হীনতা রয়েছে।’ উদাহরণস্বরূপ তিনি নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় জটিলতার কথা বলেন। এসব সমস্যা সমাধানে প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় বাড়ানো এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপরও জোর দেন তিনি।

‘ঘরে ঘরে শতভাগ বিদ্যুৎ’ নিয়ে সরকারের লক্ষ্য অর্জন প্রসঙ্গে অপু বলেন, ‘আমরা যখন আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেব, যখন নিজেদের উৎস বা নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে, তখনই সত্যিকার অর্থে শতভাগ বিদ্যুৎ বা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হব।’

এবার শাকিলা আক্তারের কাছে জলবায়ু ও জ্বালানি সুরক্ষায় নারীদের জন্য করণীয় বিষয়ে জানতে চান শওকত হোসেন। শাকিলা আক্তার বলেন, ‘ঘরে ঘরে বিদ্যুতে কিন্তু নারীদের সুরক্ষা বেড়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ-সংকট বা লোডশেডিং তৈরি হলে নারীদের সেই সুরক্ষাটি আর থাকে না। এ ক্ষেত্রে যেহেতু সরকারের ইতিমধ্যেই প্রশংসিত “সোলার হোম ডিজাইন সিস্টেম” রয়েছে, তাই দেশের প্রত্যন্ত জায়গায় বিশেষ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীদের সেই সুরক্ষা যথাযথভাবে দেওয়া সম্ভব হবে।’
আলোচনার শেষে সোহানুর রহমানের কাছে সঞ্চালক শওকত হোসেন জানতে চান, এনার্জি ট্রানজিশনের বিষয়টি কীভাবে সম্ভব?

উত্তরে সোহানুর রহমান প্রথমেই আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে সরে আসার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নয়, সোলার হোম সিস্টেমেও রোল মডেল এবং আমাদের প্রচুর অকৃষিজমিও রয়েছে সোলার বিদ্যুতের জন্য। শুধু সোলার নয়, বায়ু এবং পানিবিদ্যুতের মাধ্যমেও বাংলাদেশে এনার্জি ট্রানজিশনের বা জ্বালানিব্যবস্থা রূপান্তরের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।’
সবশেষে তিনি জ্বালানিব্যবস্থা রূপান্তরের বিষয়টি ‘ন্যায্যতার ভিত্তিতে’ বাস্তবায়নের গুরুত্ব উল্লেখ করেন।