সময়টা খারাপ—তাই চারদিক থেকে ‘মিতব্যয়ী’ হওয়ার পরামর্শ আসছে। বাজারের যে অবস্থা, তাতে ‘ব্যয়’ করাই অবশ্য বহু মানুষের জন্য কঠিন হয়ে গেছে। এরপরও সাশ্রয় কীভাবে করতে হয়, সেটি তিন–চার মাস ধরে বিদ্যুৎ বিভাগ খুব ভালোভাবেই মানুষকে ‘শিক্ষা’ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সব জায়গায় সাশ্রয় করা কাজের কাজ হতে পারে না। সেটি কোন জায়গা, তা রাখঢাক না করেই বলে দিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
কিন্তু মানুষের মধ্যে এমন দৃঢ়বিশ্বাস জন্মেছে যে সরকারি দলে পদপদবি (যে পর্যায়ের হোক) পেতে যদি বাড়তি কিছু খরচাপাতি করতেই হয়, সেটিকে কোনোভাবেই দোষের বলা যাবে না! এখানে মিতব্যয়ী হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে ‘বঞ্চিত’ করা যাবে না। বিশেষ করে যে বিনিয়োগ ‘ঝুঁকিমুক্ত’ এবং ‘নিশ্চিত লাভ’ হবে বলে মানুষ মনে করে, সেখানে টাকাপয়সার লেনদেন হতেই পারে!
‘আপনারা দলটাকে বাঁচান। টাকাপয়সার লেনদেন—এগুলো বন্ধ করেন। কমিটি করতে টাকা লাগবে—এটা বিএনপিতে হতে পারে, আওয়ামী লীগ এটা প্র্যাকটিস (চর্চা) করতে পারে না। টাকাপয়সা নিয়ে মনোনয়ন, টাকাপয়সা নিয়ে কমিটি গঠন—এই প্র্যাকটিস চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এটা শেখ হাসিনার নির্দেশ।’ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
দলীয় রাজনীতির ধারেকাছে না থেকেও টাকা দিয়ে হঠাৎ করে নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা কিংবা ক্ষমতাবান কারও ‘আশীর্বাদে’ কোনো কমিটিতে পদ বাগিয়ে নেওয়া—এই প্রবণতা রাজনীতিতে দিন দিন ‘জনপ্রিয়’ হয়েছে, হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি এখন কোন পর্যায়ে গেছে, সেটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে স্পষ্ট। তৃণমূলের রাজনীতিতে কমিটি গঠনের নামে কী চলছে—এর খানিকটা আঁচ পাওয়া যাবে তাঁর কথায়। রাজধানীর খিলগাঁও থানা এবং ওয়ার্ড কমিটির সম্মেলনে হাজির হয়ে গতকাল (২৬ অক্টোবর) তাঁকে বলতে হয়েছে, ‘আপনারা দলটাকে বাঁচান। টাকাপয়সার লেনদেন—এগুলো বন্ধ করেন। কমিটি করতে টাকা লাগবে—এটা বিএনপিতে হতে পারে, আওয়ামী লীগ এটা প্র্যাকটিস (চর্চা) করতে পারে না। টাকাপয়সা নিয়ে মনোনয়ন, টাকাপয়সা নিয়ে কমিটি গঠন—এই প্র্যাকটিস চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এটা শেখ হাসিনার নির্দেশ।’
শুধু দলীয় পদ নয়, সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন–‘বাণিজ্য’ নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা আছে। এমনকি সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েও অন্য আরেক প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সরে দাঁড়ানোর ঘটনাও আছে।
তৃণমূলে কমিটি হলে অসন্তোষ, ক্ষোভ–বিক্ষোভ খুব স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রবণতা। বড় দলে এটি কমবেশি হতেই পারে। কিন্তু গত কয়েক বছরে চাওয়া–পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ–বিক্ষোভ, মান–অভিমান ছাপিয়ে কমিটি–বাণিজ্য, পদ–বাণিজ্য—এসবই বেশি আলোচনায় আসছে। পদবঞ্চিত নেতারাই বাণিজ্যের অভিযোগ করছেন। এর সবই যে ঢালাও তা নয়।
আওয়ামী লীগের সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনেও কমিটি নিয়ে ‘বাণিজ্যের’ কথা প্রায়ই শোনা যায়। জেলা, মহানগর পর্যায়ে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা হলেই প্রথমেই যে বিষয়টি বেশির ভাগ সময় সামনে আসে, সেটি হলো ‘বাণিজ্য’। কখনো কখনো এসব কমিটিতে পদ কেনাবেচা নিয়ে অডিও ফাঁস হয়। জায়গা এবং পদের গুরুত্ব অনুযায়ী, টাকার পরিমাণ ঠিক হয়।
তৃণমূলে কমিটি হলে অসন্তোষ, ক্ষোভ–বিক্ষোভ খুব স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রবণতা। বড় দলে এটি কমবেশি হতেই পারে। কিন্তু গত কয়েক বছরে চাওয়া–পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ–বিক্ষোভ, মান–অভিমান ছাপিয়ে কমিটি–বাণিজ্য, পদ–বাণিজ্য—এসবই বেশি আলোচনায় আসছে।
শুধু দলীয় পদ নয়, সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন–‘বাণিজ্য’ নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা আছে। এমনকি সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েও অন্য আরেক প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সরে দাঁড়ানোর ঘটনাও আছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের হয়ে লক্ষ্মীপুর–২ (রায়পুর ও লক্ষ্মীপুর সদরের নয়টি ইউনিয়ন) আসনের প্রার্থী ছিলেন জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ নোমান। ভোটের মাত্র ১২ দিন আগে হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে সরে দাঁড়ান তিনি। তখন আলোচনা হয়েছিল, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী শহিদ ইসলামের কাছ থেকে ১২ কোটি টাকা নিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। ওই সময় লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক প্রকাশ্যে দলের এক সভায় বলেছিলেন, ‘বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নোমান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন ।...অনেক টাকা, অনেক টাকা।’
আর প্রার্থী নোমানের ব্যক্তিগত সহকারী শাহ আলম তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, কাজী শহিদ ইসলামের কাছ থেকে ১২ কোটি টাকা নিয়ে তিনি (নোমান) সরে দাঁড়িয়েছেন বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। (আলোচিত এ ঘটনা নিয়ে ২০১৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—‘টাকা’ নিয়ে সরে দাঁড়ান মহাজোট প্রার্থী)।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন দিন আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী শহিদ ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘গত আড়াই বছরে আমি বিপুল কাজ করেছি। বুঝতে পারছেন? প্রায় ৩২ কোটি টাকা মানবসেবায় খরচ করেছি।’
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, টাকার জোরে সংসদ সদস্য ‘বনে যাওয়া’ শহিদ ইসলাম তাঁর এই পদ টিকিয়ে রাখতে পারেননি। কুয়েতের সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে মানব পাচারের ঘটনায় দেশটির একটি ফৌজদারি আদালত ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি শহিদ ইসলামকে চার বছরের কারাদণ্ড দেন এবং ৫৩ কোটি টাকা জরিমানা করেন। পরে দেশেও তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল করা হয়। তিনি এখনো কুয়েতের কারাগারে সাজা খাটছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেন, মানব ও মুদ্রা পাচারের মামলা রয়েছে কুয়েতে।
দেশের রাজনীতিতে টাকার প্রভাব এখন কোন পর্যায়ে গেছে, সেটি জেলা পরিষদ নির্বাচনের পর আরও স্পষ্ট হয়েছে। ভোট পেতে ভোটারদের (স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তাঁরা) টাকা দেওয়ার কথা প্রকাশ্যেই বলছেন তাঁরা। ১৭ অক্টোবর এই নির্বাচন শেষ হওয়ার পর পরাজিত সদস্য প্রার্থীদের কেউ কেউ ভোটারদের কাছে টাকা ফেরত চাইছেন। আবার কেউ টাকা ফিরে পেতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস পর্যন্ত দিয়েছেন। তাঁদের একজন আ. রাজ্জাক সরদার। তিনি জামালপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে সদস্য প্রার্থী ছিলেন। টিউবওয়েল প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১৭১টি ভোটের মধ্যে ৪৮টি ভোট পাওয়া রাজ্জাক জেলার ইসলামপুর উপজেলার গাইবান্ধা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এখনকার ভোটাররা টাকা ছাড়া ভোটও দেন না। সম্মানের কথা চিন্তা করে ভোটারদের টাকাও দিলাম। ১৭১ জন ভোটারের মধ্যে ৯৮ জনকে সর্বনিম্ন ৩০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার করে টাকা দিয়েছি। নির্বাচনের আনুষঙ্গিক আরও খরচ ছিল। সব মিলিয়ে ৪০ লাখ টাকার মতো খরচ করেছি। কিন্তু ভোট পেয়েছি মাত্র ৪৮টি। তাহলে বাকি ৫০ জন টাকা নিয়েও আমাকে ভোট দেননি। তাহলে অবশ্যই তাঁরা অন্য প্রার্থীর কাছ থেকে আরও বেশি টাকা নিয়ে ভোট দিয়েছেন।’
পটুয়াখালী জেলা পরিষদের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ভোটারদের কাছে টাকা ফেরত চেয়েছেন সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদের প্রার্থী রুবিনা আক্তার। ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্যের (ভোটার) কাছ থেকে তাঁর টাকা ফেরত চাওয়ার সময় বাগ্বিতণ্ডার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল (ছড়িয়ে পড়া) হয়েছে।
টাকা থাকলে ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়া যায়, আবার ক্ষমতা থাকলে টাকার পাহাড় বানানো যায়—এটি এখন প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। তাই যার যেখানে সুযোগ আছে, সেটি দলীয় পদ হোক বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হোক—যেকোনোভাবে পেতে হবে। ক্ষমতা পাওয়ার এবং ধরে রাখার এই প্রতিযোগিতায় টাকার লেনদেনই শেষ কথা।
ইমাম হোসেন সাঈদ। ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো