সাদা বালিয়াড়িতে আছড়ে পড়ছে ঢেউ, রোদে চিকচিক করে ওঠা সাগরের নীল জল চিরে চলে যাচ্ছে দ্রুতগামী স্পিডবোট—এত ওপর থেকে তাকে মনে হচ্ছে কাগজের ছোট্ট নৌকার মতো। গাঙচিলের মতো উড়তে উড়তে এমন দৃশ্য উপভোগ আর কল্পনার বিষয় নয়। কক্সবাজারে বেড়াতে গেলে এখন প্যারাসেইলিংয়ের দৃশ্য চোখে পড়ে। প্যারাস্যুটে ভর করে আকাশে উড়ে উড়ে পাখির চোখে সৈকতের দৃশ্য দেখতে ভিড় করেন অ্যাডভেঞ্চার–প্রিয় পর্যটকেরা। এ জন্য জনপ্রিয় হচ্ছে প্যারাসেইলিং।
কক্সবাজার শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে মেরিন ড্রাইভের দরিয়ানগর পর্যটনপল্লির সৈকতে যেতে হবে প্যারাসেইলিং করতে হলে। এখানে এলেই চোখে পড়বে বড় একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা আছে, ‘ফ্লাই এয়ার সি স্পোর্টস প্যারাসেইলিং’। পাশে টিকিট কাউন্টার। টিকিটের মূল্য ২ হাজার ও ২ হাজার ৫০০ টাকা। ২ হাজার টাকার টিকিটে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট আকাশে ওড়া যায়। আর ২ হাজার ৫০০ টাকার টিকিটে আকাশে ওড়ার পাশাপাশি সমুদ্রের লোনাজলে পা ভেজানোর সুযোগ পাওয়া যায়। পর্যটকদের আকাশে ওড়ানোর জন্য সেখানে রাখা আছে চারটি প্যারাসেইল, একটি দ্রুতগতির জলযান জেটস্কি ও দুটি স্পিডবোট। ২৩ জন স্বেচ্ছাসেবক পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
গত রোববার দুপুরে দরিয়ানগর সৈকতে গিয়ে দেখা গেছে, আকাশ থেকে নিচের সমুদ্রসৈকত ও পাহাড় দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছেন বিপুলসংখ্যক পর্যটক। ঢাকার রাজারবাগ এলাকার ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান (৫২) বলেন, তিন বছর আগে তিনি থাইল্যান্ডের পাতায়া সৈকতে প্যারাসেইলিংয়ে চড়েছেন। দরিয়ানগর সৈকতে এসেছেন কলেজপড়ুয়া এক মেয়ের ইচ্ছা পূরণ করতে।
ফ্লাই এয়ার সি স্পোর্টস প্যারাসেইলিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফরিদ প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারের পর্যটনের প্রসার এবং ভ্রমণে আসা পর্যটকদের বাড়তি বিনোদন দিতে তিনি পাঁচ বছর আগে প্যারাসেইলিং শুরু করেন। কিন্তু এত দিনেও তিনি লাভের মুখ দেখেননি। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্যারাসেইলিং জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশে তেমন পরিচিতি পায়নি। মানুষজন শিশু-কিশোরদের নিয়ে প্যারাসেইলিং দেখতে আসেন, কিন্তু আকাশে উড়তে ভয় পান। কিন্তু যাঁরা একবার প্যারাসেইলিং করেছেন, তাঁরা বারবার করতে চান।
প্যারাসেইলিং প্রতিষ্ঠার বিপরীতে দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ফরিদ। তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার থেকে কক্সবাজারে কয়েক লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটে। প্যারাসেইলিংয়ের জন্য অনেকে সৈকতে ভিড় জমাচ্ছেন। কিন্তু বাতাসের কারণে ঠিকমতো প্যারাসেইলিং করা যাচ্ছে না। বাতাস কম থাকলে প্যারাস্যুট ওড়ানো যায় না, তেমনি বাতাস বেশি হলেও সম্ভব হয় না। এখন দৈনিক ৩০-৩৫ জন প্যারাসেইলিং করার সুযোগ পাচ্ছেন।
পাখির চোখে সুন্দরের দর্শন
প্যারাসেইলিং চড়তে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দরিয়ানগর সৈকতে জড়ো হন ২৫-৩০ জন পর্যটক। অধিকাংশ তরুণ-তরুণী। মতিঝিলের ব্যবসায়ী ইব্রাহিম খলিলকে দেখা গেল প্যারাসেইলিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রথমে তাঁকে লাইফ জ্যাকেট পরানো হলো। এরপর বাঁধা হয় প্যারাস্যুটের রশি। কিছুটা দূরে সমুদ্রের পানিতে ভাসমান আছে একটি স্পিডবোট। রশি স্পিডবোটের সঙ্গে বাঁধা। স্পিডবোট যখন সমুদ্রের জলরাশির ওপর দিয়ে ছুটে চলে, তখন ধীরে ধীরে আকাশে উড়তে থাকে প্যারাস্যুট।
মাটিতে পা রেখে ইব্রাহিম খলিল বলেন, প্যারাস্যুট যখন আকাশে উঠছিল, তখন প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। কিছু দূর ওঠার পর ভয় কেটে গেছে। নিচের সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে পিঁপড়ার মতো ছোট মনে হলো। সমুদ্রের পানি চিকচিক করছিল। সমুদ্রের পানিতে ছুটে চলা ট্রলার, পাশের পাহাড়সারি দারুণ উপভোগ্য।
প্যারাসেইলিং পরিচালনা করেন দুজন। আবদুল জলিল ও মো. জমির। দুজনই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। মালয়েশিয়ার পেনাং সৈকতে তাঁরা দুজন ১০-১২ বছর প্যারাসেইলিং পরিচালনা করেছিলেন।
আবদুল জলিল (৪৫) বলেন, ১২ বছরের নিচে কাউকে প্যারাসেইলিং করতে দেওয়া হয় না। এ ছাড়া ১২০ কেজির বেশি ওজনের মানুষ, দুর্বল চিত্তের লোকজন অথবা হৃদ্রোগের সমস্যা আছে—এমন লোকজন ছাড়া যেকোনো নারী-পুরুষ নিশ্চিন্তে প্যারাসেইলিং করতে পারেন। প্যারাসেইলিংয়ের টিকিট কেনার সময় উড্ডয়নকারীকে কাগজে অঙ্গীকারনামা বা চুক্তিতে সই করতে হয়। চুক্তিতে লেখা থাকে প্যারাসেইলিং করার সময় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দায়দায়িত্ব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নেবে না।
প্যারাসেইলিং করার সময় দুর্ঘটনার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। প্যারাসেইলিং কোম্পানির নিরাপত্তা সরঞ্জাম ঠিকঠাক আছে কি না, তা দেখে নিতে হবে। অনেকে হাতে মুঠোফোন, চোখে চশমা ব্যবহার করেন। কেউ কেউ মুঠোফোনে সেলফি ও ভিডিও ধারণের চেষ্টা করে থাকেন। তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। হাত থেকে ফসকে মুঠোফোন সমুদ্রে পড়ে গেলে ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে আকাশে ওড়ার রোমাঞ্চকর দৃশ্য ধারণ করতে চাইলে বডি মাউন্টেড অ্যাকশন ক্যামেরা ব্যবহার করা যেতে পারে।