আনু মুহাম্মদ
আনু মুহাম্মদ

বিশেষ লেখা: আনু মুহাম্মদ

বৈষম্য, নিপীড়ন ও আধিপত্যমুক্ত বাংলাদেশ চাই

ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে বৈষম্য, নিপীড়ন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের অদম্য লড়াই অসংখ্য গাথা তৈরি করেছে। ঔপনিবেশিক শাসন, সামরিক-বেসামরিক স্বৈরশাসন, জাতিগত নিপীড়ন ও অসমতার বিরুদ্ধে এবং ভাষা, শিক্ষার অধিকার, গণতন্ত্র ও সাম্যের জন্য আমাদের বারবার লড়াই করতে হয়েছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এই সংগ্রামের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা। প্রবল দানবীয় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণের অপ্রতিরোধ্য লড়াই ছিল সেটি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতর জাতিগত নিপীড়ন, অপমান, আঞ্চলিক বৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণিবৈষম্যের বিরুদ্ধে চৈতন্য তৈরিতে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, লেখক, শিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, পেশাজীবী অনেকেরই ধারাবাহিক ভূমিকা ছিল। এর মধ্য দিয়ে একাত্তরের আগে যে ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্নের জন্ম হয়, তার শক্তি দিয়েই একাত্তরে সংঘটিত হয় মুক্তিযুদ্ধ।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে বিশাল প্রত্যাশা তৈরি করেছিল, তা পূরণ হয়নি। তবে তার প্রতিফলন সংবিধানের একটি অংশে এখনো আছে।

গত ৫৩ বছরে শাসনক্ষমতায় থাকা দল ও গোষ্ঠীর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখার তাড়নায় এসব অঙ্গীকার বরাবর অকার্যকর করে রাখা হয়েছে; বরং এসবের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ধারা ও আইন রাখার পাশাপাশি একের পর এক সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বহু রকমের বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক এবং সাম্প্রদায়িক বিধানই প্রধান হয়ে উঠেছে সংবিধানে। এটি একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সাম্য ও ন্যায়বিচারের কথা বলেছে, কিন্তু অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে প্রান্তিক এবং ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে বৃহত্তর কর্তৃত্ববাদের পথ প্রশস্ত করেছে। বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের কারণে সর্বজনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক অধিকার বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে।

গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির আয়তন বেড়েছে অনেক। অবকাঠামোর বিস্তার ঘটেছে, জিডিপি বেড়েছে বহুগুণ, আমদানি-রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু একই সময়ে শ্রেণিবৈষম্যও বেড়েছে উৎকটভাবে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বদলে দেশ চলে গেছে মুষ্টিমেয়র হাতে। শ্রেণি-আধিপত্য প্রবল হয়েছে। জিডিপিতে নিচের ৯০ শতাংশের অংশীদারত্ব কমে শীর্ষ ১০ শতাংশের হাতে দেশের প্রধান সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যার সিংহভাগ আরও শীর্ষ ১ শতাংশের দখলে। এদের কারণে দেশের বিপুল সম্পদ লুণ্ঠিত ও পাচার হয়েছে, দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে, বারবার স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে আটকে গেছে দেশ। দেশের নদী-বন-পাহাড়-বাতাস, অর্থাৎ প্রাণপ্রকৃতি বিপর্যস্ত হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা, বঞ্চনা ও জুলুম অব্যাহত আছে। দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান শ্রেণিবৈষম্যের অন্যতম চিহ্ন। এসবের ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণ জনসংখ্যার একটি বড় অংশের প্রকৃত আয় কমিয়েছে। চিকিৎসা বা সন্তানদের শিক্ষিত করাতে গিয়ে তাদের অনেকে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় সমস্যা লিঙ্গবৈষম্য—শুধু নারী ও পুরুষের মধ্যে নয়, বরং অন্যান্য লিঙ্গও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এই বৈষম্য ঘরের ভেতরে ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই ঘটে। সম্পত্তি ও সন্তানের অধিকার, খেলাধুলা, কর্মসংস্থান ও চলাফেরার মতো ক্ষেত্রগুলোতে নারীর প্রতি বৈষম্য এখনো অত্যন্ত প্রবল এবং সামাজিক আইনগত বিধিব্যবস্থা প্রতিকূল। নারীর নিরাপদ জীবন, চলাফেরা, শিক্ষা ও কাজের অধিকার, সম্মান, স্বাধীন সিদ্ধান্তের ক্ষমতা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের অন্যতম শর্ত, যা এখনো পূরণ হয়নি।

তৃতীয় সমস্যা জাতিগত ভাষাগত বৈষম্য। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়া অন্য জাতিসত্তা ও ভাষাভাষীর অস্তিত্ব সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত নয়। উপরন্তু তাদের জমি, ভাষা, সংস্কৃতি—সবকিছুই দখলদারদের থাবার মুখে। এর ওপর আছে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাহীনতা।

চতুর্থ সমস্যা ধর্মীয় বৈষম্য। শুধু সংখ্যাগুরু থেকে ভিন্ন ধর্মের মানুষই বৈষম্যের শিকার নন, একই ধর্মের মধ্যেও সংখ্যালঘু ও দুর্বল গোষ্ঠী বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। ইসলামের ভেতরে ও বাইরে দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটানো বৈষম্যবাদী ব্যবস্থারই ফলাফল।

মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘ এক দশকের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান সামরিক স্বৈরশাসন উৎখাত করলেও স্বৈরতন্ত্র ও বৈষম্যবাদী রাজনীতির আধিপত্য থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে পারেনি।

গত জুলাই-আগস্টের শিক্ষার্থী-জনতার গণ-অভ্যুত্থান দেড় দশক ক্ষমতায় থাকা একটি গভীর দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাত করেছে। এতে দেশের নানা ধর্মীয়, জাতিগত, লিঙ্গ ও শ্রেণির নাগরিকদের অংশগ্রহণ ছিল। এই গণ–অভ্যুত্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পর অপূর্ণ থাকা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে, স্বৈরাচার ও বৈষম্যমুক্ত সমাজের জন্য শক্তিশালী জনমত তৈরি হয়েছে। দেয়ালে কিশোর-তরুণদের আঁকা চিত্রগুলোও এই পরিণত বার্তাই প্রকাশ করে। এসব চিত্রের স্পষ্ট বক্তব্য এটাই যে ধর্মপরিচয় দিয়ে কোনো বিভেদ সৃষ্টি গ্রহণযোগ্য নয়, বাঙালিসহ আরও বহু জাতির দেশ এই বাংলাদেশ। তারা জাতি-ধর্ম-লিঙ্গের সমতাপূর্ণ একটি ন্যায়সংগত বাংলাদেশ দাবি করে।

ইতিহাসে বহুবার সর্বজনের লড়াই স্বৈরতন্ত্রী বৈষম্যবাদী ক্ষমতার বিরুদ্ধে রক্ত ঢেলেছে। প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বৈষম্যের উৎস নির্মূলের প্রশ্ন আসে। এর জন্য ধর্ম-লিঙ্গ-জাতি-শ্রেণিসহ সব রকম বৈষম্যবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধেই আমাদের দাঁড়ানো কর্তব্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান সেই তাগিদই বারবার হাজির করছে।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক