১৯৯০ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবছর ১ অক্টোবর প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রবীণদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে দিবসটি পালন করা শুরু হয়। সাধারণত এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব এবং উন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য ৬৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সীদের প্রবীণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
একবিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি, সচেতনতা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে মৃত্যুহার হ্রাসের পাশাপাশি মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে বিশ্বে প্রবীণের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের কথায়, জীবনের সঙ্গে আমাদের ‘অতিরিক্ত’ বছর যোগ করা সম্ভব হয়েছে কিন্তু বাড়তি এই বছরগুলোতে জীবনের স্পন্দন যোগ করতে আমরা পারিনি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ প্রবীণ রয়েছেন। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখে। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা হবে প্রায় সাড়ে চার কোটি। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনে একজন প্রবীণ হবেন, যা ওই সময়ের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। তবে একই সময়ে শিশুর সংখ্যা হবে ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশে ২০৫০ সালে শিশুর চেয়ে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা হবে ১ শতাংশ বেশি।
ইউনিসেফ আভাস দিয়েছে, আগামী দুই থেকে আড়াই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ প্রবীণপ্রধান দেশে পরিণত হবে। ইউনিসেফের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৯৭৮ সাল থেকে মোট জনসংখ্যায় কর্মক্ষম মানুষের হার বাড়তে থাকে, জনসংখ্যা থেকে উন্নয়নের সুবিধা (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) পাওয়ার সুযোগ তখন থেকেই শুরু। এখন মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬২ ভাগ কর্মক্ষম যুবক, যা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে। ২০৩৩ সালে কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার দ্রুত কমতে শুরু করবে। সেই অনুযায়ী দেশ আর মাত্র ১২ বছর এই সুবিধা পাবে। ফলে, তখন আমাদের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
জনসংখ্যার হার বিবেচনায় কোনো দেশ বা সমাজকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ বা তার বেশি মানুষ বয়স্ক হলে সেটি হবে প্রবীণপ্রবণ সমাজ। আর মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ বা তার বেশি বয়স্ক মানুষ হলে সেটি প্রবীণপ্রধান সমাজ। তাই বাংলাদেশ এখন প্রবীণপ্রবণ সমাজে অবস্থান করছে। তবে আগামী দুই থেকে আড়াই দশকের মধ্যে প্রবীণপ্রধান সমাজে পরিণত হবে বাংলাদেশ। এর জন্য যে প্রস্তুতি দরকার, সেটা থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে।
তদুপরি পরিবার ও সমাজে লিঙ্গবৈষম্যের কারণে পুরুষের তুলনায় প্রবীণ নারীদের ভোগান্তি, অসহায়ত্ব, একাকিত্ব সর্বোপরি জটিলতা বহুমাত্রিক। আমাদের সমাজে অনেক প্রবীণ নারীর ছোটবেলার পুতুল খেলার মাঝেও বিয়ে হয়েছে, কারওবা হয়েছে কিশোরী কিংবা যুবতী অবস্থায়, সে মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির সম্পর্ক। জন্মের পর থেকে ওই মা শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক—সব ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, যাতে তাঁর সন্তানেরা নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। একই সঙ্গে সর্বশক্তি বিলিয়ে দেওয়া মা ক্রমান্বয়ে হতে থাকেন প্রবীণ। কালের বিবর্তনে মায়ের ওপর সন্তানের নির্ভরশীলতা যখন হ্রাস পেতে থাকে, সন্তানের ওপর মায়ের নির্ভরশীলতা ততই বাড়তে থাকে। সন্তান যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত, মা তখন বয়সের ভারে ন্যূব্জ, শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল, ক্ষমতাহীন, পরমুখাপেক্ষী। লিঙ্গবৈষম্য এই মাত্রাকে তীব্রতর করে। কোভিড মহামারি বিদ্যমান বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। গত তিন বছরে বয়স্ক ব্যক্তিদের জীবনে, বিশেষ করে প্রবীণ নারীদের আর্থসামাজিক, পরিবেশগত, স্বাস্থ্য ও জলবায়ু–সম্পর্কিত প্রভাব তাঁদের জীবনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে।
তদুপরি আমাদের সমাজে সাধারণত স্ত্রীর চেয়ে স্বামীদের বয়স গড়ে ৫-৬ বছর বেশি থাকে। খেয়ালি প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে নারীরা বাঁচেনও আবার বেশি দিন। যেখানে বাংলাদেশের পুরুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৬ বছর, সেখানে নারীর গড় আয়ু প্রায় ৭৬ বছর। জীবন পরিক্রমার শেষ প্রান্তে নারীদের ৭–৮ বছর বেশি বাঁচতে হয় বিধবা হিসেবে, ক্ষমতাহীন ও পরমুখাপেক্ষী হয়ে। আবার প্রবীণ নারীর পক্ষে তখন বয়স্ক স্বামীর সেবাশুশ্রূষা করাই হয়ে দাঁড়ায় চ্যালেঞ্জের, পর্বতসম কষ্টের। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে বিধবা প্রবীণ নারীকে সুনিপুণভাবে শুধু জেন্ডার–বৈষম্যের কারণে স্বামী, ভাই, ছেলেসহ অতি ঘনিষ্ঠজনেরা রাখেন নিঃস্ব ও একাকিত্বে সর্বোপরি ক্ষমতাহীন করে।
প্রতিবছর ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস’-এ দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এবার মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘বয়স্ক নারীদের সহনশীলতা ও অবদান’। প্রবীণ নারীদের অত্যাবশ্যক অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া এবং স্থানীয়, জাতীয় সব ক্ষেত্রে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ ও বিপর্যয় একত্রিত করে যৌক্তিক নীতি তৈরি করা, যাতে তাঁদের কণ্ঠস্বর, দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্তর্ভুক্তি প্রতিফলিত হয়। ফলেæপ্রবীণ নারীরা যেন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করার পাশাপাশি সহনশীলতা ও দৃঢ়তায় সব প্রতিকূলতা সমাধানে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। জাতিসংঘ বয়স্ক ব্যক্তি ও বার্ধক্য সম্পর্ক নেতিবাচক স্টেরিওটাইপ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভুল ধারণার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের জন্য এবং প্রবীণ নারীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাকে পরিবার ও সমাজ যাতে উপলব্ধি করে, এ জন্য এবারের আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে।
এর মূল উদ্দেশ্য হলো ১. পরিবেশগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আজীবন বৈষম্যের মধ্যে প্রবীণ নারীর সহনশীলতা তুলে ধরা; ২. বিশ্বব্যাপী প্রবীণ নারীর প্রতি বয়স্ক ও লিঙ্গবৈষম্যের তথ্য সংগ্রহের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো; ৩. লিঙ্গসমতা নিশ্চিতে সব নীতির কেন্দ্রে প্রবীণ নারীদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সদস্যদেশ, জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা, ইউএন উইমেন ও সুশীল সমাজের প্রতি আহ্বান। ফলে চিরবঞ্চিত এই প্রবীণ নারীদের যেন সমাজে অন্য সবার মতো সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত হয়। এর মাধ্যমে তাঁদের সারা জীবন সহনশীলতা ও অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা সম্ভব হবে।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করা আবশ্যক, এবার আমাদের প্রবীণবান্ধব প্রধানমন্ত্রীও জাতিসংঘে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের যুক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, লিঙ্গসমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে তাঁর সরকার প্রতিশ্রতবদ্ধ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি খাতে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আজকের মেয়েশিশু তথা ভবিষ্যতের প্রবীণ নারীর সমস্যা যদি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায় এবং তা দূর করার জন্য পারিবারিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সাংস্কৃতিক, চেতনাগত, দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবেই লিঙ্গ ও বয়স বৈষম্যহীন সমাজ গড়া সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে যুব সমাজের সোচ্চার ভূমিকার পাশাপাশি সরকার, রাষ্ট্র–প্রশাসন, নীতিনির্ধারক, আইনজ্ঞ, প্রচারকসহ সচেতন সবাইকে আন্তরিক ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলেই সম্ভব হবে লিঙ্গ ও বয়স বৈষম্যহীন প্রবীণ নারীর প্রতি পূর্ণ মানবিকতার প্রতিষ্ঠা। একই সঙ্গে এবারের আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের যথার্থতা স্বীকৃতি পাবে।
ড. দিলীপ কুমার সাহা, জেরেন্টোলজিস্ট ও প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক, সিআইডি বাংলাদেশ পুলিশ