দেশে গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস বা জেসটেশনাল ডায়াবেটিস মেলিটাসে (জিডিএম) আক্রান্ত হওয়ার হার ৮ থেকে ৩৫ শতাংশ। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস মা ও গর্ভের সন্তানের জন্য নানা জটিলতা বয়ে আনে। অথচ অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ সেই পরিবারের সদস্যদের প্রায় ৭৯ শতাংশই গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানেন না। গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার সময় ও গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে, যাতে শুরুতেই সমস্যা শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীতে বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির (বিইএস) ডায়াবেটিস ইন প্রেগন্যান্সি টাস্কফোর্স আয়োজিত এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন ও সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কার্যক্রমে এসব কথা বলেন চিকিৎসকেরা।
ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ চৌধুরী হলে ‘গর্ভকালীন ডায়াবেটিস: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট ও আমাদের করণীয়’ শিরোনামের এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়। এই শিরোনামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মার্কস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাজমা আক্তার।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের গ্রামে ৮ শতাংশ ও শহরে প্রায় ১৩ শতাংশ নারী জিডিএমে আক্রান্ত। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮–এর উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের ৩৫ শতাংশ নারী জিডিএমে আক্রান্ত। আক্রান্তের এই উচ্চ হার থাকলেও অন্তঃসত্ত্বা নারী নিজে, তাঁর মা, স্বামী, শাশুড়িসহ পরিবারের প্রায় ৭৯ শতাংশ সদস্য জিডিএম সম্পর্কে জানেন না। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ডায়াবেটিস পরীক্ষা করার কথা জানেন না ৮৩ শতাংশ।
কোনো অন্তঃসত্ত্বা নারীর খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৫ দশমিক ১ মিলিমোল/লিটার এবং গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ৮ দশমিক ৫ মিলোমোল/লিটার এলে তাঁর গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আছে বলে ধরা হয়।
প্রবন্ধে আরও বলা হয়, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কারণে গর্ভস্থ শিশু আকারে অস্বাভাবিক বড়, শিশুর জন্মগত ত্রুটি, সময়ের আগে জন্ম ও গর্ভেই মৃত্যু হতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থেকে কিছু মায়ের স্থায়ী ডায়াবেটিস হতে পারে। আবার অনেক মা ও সন্তানের ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস হওয়ার উচ্চঝুঁকি থাকে।
ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ইনসুলিন ব্যবহারের নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এম সাইফুদ্দিন। তিনি জানান, গর্ভাবস্থায় ইনসুলিন একমাত্র ও সবচেয়ে নিরাপদ চিকিৎসা।
কোনো অন্তঃসত্ত্বা নারীর খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৫ দশমিক ১ মিলিমোল/লিটার এবং গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ৮ দশমিক ৫ মিলোমোল/লিটার এলে তাঁর গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আছে বলে ধরা হয়। এ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা নারীর খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৭ মিলিমোল/লিটার এবং গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ১১ দশমিক ১ মিলোমোল/লিটার হলে তাঁর ওভার্ট ডায়াবেটিস বা গর্ভধারণের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে বলে ধরা হয়।
সম্মেলনে জানানো হয়, গর্ভাবস্থার ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিস পরীক্ষা জরুরি। যাঁদের ওজন বেশি, কায়িক শ্রম কম, পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে, তাঁরা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন। তাঁদের গর্ভকালীন প্রথম পরীক্ষার সময় ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা দরকার। এই সময় নেগেটিভ এলেও গর্ভাবস্থার ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে আবারও পরীক্ষা করতে হবে।
সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী রোকেয়া সুলতানা বলেন, ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতা বাড়লে রোগ নিয়ে দুর্ভোগ কমে আসে। সুস্থ মা ও সুস্থ শিশুর জন্য গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ সরকার প্রান্তিক মানুষের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক করেছে। সেখানে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তশূন্যতা ও ডায়াবেটিস শনাক্তের বিষয়ে সহায়তা করা হয়। সরকার এখন ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ইনসুলিন দিচ্ছে বিনা মূল্যে।
অন্তঃসত্ত্বা নারীর খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৭ মিলিমোল/লিটার এবং গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ১১ দশমিক ১ মিলোমোল/লিটার হলে তাঁর ওভার্ট ডায়াবেটিস বা গর্ভধারণের পূর্ব থেকেই ডায়াবেটিস আছে বলে ধরা হয়।
অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বলেন, নতুন দম্পতিকে গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার আগে জিডিএম নিয়ে সচেতন হতে হবে। পরিবারগুলোকে বোঝাতে হবে, মা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে সন্তানও ঝুঁকিতে পড়ে। যাঁদের ডায়াবেটিস আগে ছিল, কিন্তু এখন নেই বা যাঁরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাঁদের জানতে হবে—কখন নিরাপদে গর্ভধারণ করা যাবে।
বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির চিফ পেট্রোন অধ্যাপক মো. ফারুক পাঠান বলেন, জিডিএম যেন না হয়, সে কারণে গোড়ায় নজর দিতে হবে। মায়ের পুষ্টিহীনতা থেকে অপুষ্ট সন্তান জন্ম ও পরবর্তী জীবনে ওই সন্তানের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকে। পরিকল্পিতভাবে গর্ভধারণের মাধ্যমে মা ও সন্তান সুস্থ থাকতে পারে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, পরিমিত খাবার খেতে হবে, শরীরচর্চা করতে হবে।
গর্ভাবস্থার ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিস পরীক্ষা জরুরি। যাঁদের ওজন বেশি, কায়িক শ্রম কম, পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে, তাঁরা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন।
স্বাগত বক্তব্যে ডায়াবেটিস ইন প্রেগন্যান্সি টাস্কফোর্সের সমন্বয়ক তানজিনা হোসেন বলেন, জিডিএমের ঝুঁকি কমাতে বিভিন্ন পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কার্যক্রম নিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৬ বছরের বেশি বয়সীদের লক্ষ্যে রেখে প্রচার চালাতে হবে। তাঁদের সঠিক ওজন ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে উৎসাহিত করতে হবে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট, গাইনি, পুষ্টিবিদ ও শিশু চিকিৎসকদের নিয়ে সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য জিডিএম কর্নার চালু করা দরকার।
প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন ওজিএসবির মহাসচিব অধ্যাপক সালমা রউফ ও বারডেমের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারিয়া আফসানা। সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্য দেন বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান। সমাপনী বক্তব্য দেন বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সহযোগী অধ্যাপক শাহজাদা সেলিম। সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন রিফাত ফেরদৌস।