শিল্পী আবদুস কুদ্দুসের বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুরে। বয়স ৭০ ছুঁয়েছে। এ বয়সেও তাঁর ধ্যানজ্ঞান পুতুলনাচ। কুষ্টিয়ার ‘মনহারা’ পুতুলনাচের দল চালান তিনি। সেই ১৯৭২ সালে দলের যাত্রা শুরু, এখনো জীবনের সব আনন্দ খুঁজে পান মনহারায়, পুতুলনাচ ঘিরে।
পুতুলনাচের আগের সেই জৌলুশ এখন ফিকে হয়ে এসেছে। এরপরও পেশা বদলের কথা কখনো ভাবেননি আবদুস কুদ্দুস। প্রথম আলোকে বললেন, ‘নিরানন্দের কাজে আগ্রহ নেই। জীবনের সব আনন্দ মনহারা দলের পুতুলনাচকে কেন্দ্র করে।’
এখন হাতে প্রায়ই বায়না থাকে না। তখন মন খারাপ হয়। উদাস হয়ে একা একা গুনগুন করে গান ধরেন। জিজ্ঞেস করি, মন খারাপে কোন গান গুনগুনিয়ে ওঠেন? উত্তরে শোনালেন লোকগানের কয়েক কলি, ‘তোমরা শুনিয়া করবেন কী, জানিয়া করবেন কী...হায়রে নষ্ট করলা বন্ধু আমার দারুণ পিরিতি।’
পুতুলনাচের আগের সেই জৌলুশ এখন ফিকে হয়ে এসেছে। এরপরও পেশাবদলের কথা কখনো ভাবেননি আবদুস কুদ্দুস। প্রথম আলোকে বললেন, ‘নিরানন্দের কাজে আগ্রহ নেই। জীবনের সব আনন্দ “মনহারা” দলের পুতুলনাচকে কেন্দ্র করে।’
গান থামিয়ে বললেন, ‘শিল্পীর মনে আনন্দ না থাকলে কি পৃথিবীটা সুন্দর থাকে? তাই গানবাজনা করে মনে আনন্দ রাখি। মনহারার আসরে আমি কারিগর, আমিই পালা লেখক, গায়ক, পুতুলের কণ্ঠশিল্পী। অনেক ভূমিকা আমার।’
মঞ্চে আবদুস কুদ্দুস যে কত ভূমিকায় নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন, তা জানা গেল তাঁর অতীতের গল্প শুনে। গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি নিজেকে গান, নাচ, অভিনয়ের সঙ্গে জড়িয়েছেন। তখন বয়স কম ছিল। শুরুর দিকে টানা ১৬ বছর তিনি শাড়ি পরে নারী সেজে মঞ্চে হাজির হতেন। নারীর কণ্ঠে গাইতেন, নাচতেন।
এই শিল্পী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন শৌখিন মানুষ। তাই আমার নাচ-গান শেখায় তাঁর আপত্তি ছিল না। ওই সময় পুতুলনাচের পরপরই মেয়েলি গান (নারীকণ্ঠে গান) হতো। সেই গান গাওয়ার জন্য নারী খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। তাই নারী সেজে মঞ্চে উঠতে হতো। আফসোস, ওই সময়ে তোলা একটাও ছবি নাই। মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরের সময়ের কথা বলছি। এখনকার মতো তখন ছবি তোলার চল ছিল না।’
শিল্পী আবদুস কুদ্দুসের বয়স হয়েছে। পুতুলনাচের দিনও আগের মতো নেই। মিলছে না পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা। তবু ডাক পেলে দেশের যেকোনো জায়গায় পুতুলকে সঙ্গী করে ছুটে যান। কিন্তু এখন ডাক আসার সংখ্যাও অনেক কমে গেছে।
ছবি না থাকলেও শিল্পীর মানসপটে সেই স্মৃতি এখনো অমলিন। গ্রামগঞ্জে আগে পুতুলনাচ পরিবেশিত হতো রাতে। এক একটা পালার পর হতো গান। মেয়েলি কণ্ঠ কেমন করে আনতে হয় জানতে চাইলে বললেন, ‘সরু গলার স্বর উচ্চারণ করে করে অনুশীলন করতে হয়।’
আবদুস কুদ্দুসের মনহারা পুতুলনাচের দলের সংগ্রহে এখন ৫০টির বেশি পুতুল আছে। আগেকার অনেক পুতুল নষ্ট হয়ে গেছে। তাই নতুন করে ৩০টি পুতুল বানাতে হয়েছে তাঁকে। এর একটা বড় খরচ আছে।
গত ৮ ও ৯ অক্টোবর পাবনা ও কুষ্টিয়ায় পুতুলনাচের শো করেছেন। আয়োজক ছিল জেলা শিল্পকলা একাডেমি। এক পর্বে ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পালা। পরের অংশে ছিল ‘রংবাজ’ নামের একটি পালা। সাধারণ দর্শকের কথা চিন্তা করে এ পালা করা হয়। একেকটি পালা প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা করে চলে। প্রতি পালায় ২০টির মতো উপস্থাপনা থাকে।
একেকটি পালায় ১২ থেকে ১৩টি মানুষের চরিত্র থাকে। বাকিগুলো বিভিন্ন পশুপাখির। এগুলোও বানাতে হয়। আবদুস কুদ্দুসের বানানো পুতুলের নাম ‘আঙুরবালা’, ‘ময়নামতি’। মনহারা পুতুলনাচের দলের বিখ্যাত পালার মধ্যে আছে ‘সীতার বনবাস’, ‘রূপবান’, ‘রাজকন্যা মণিমালা’, ‘হিংসার পরিণাম’।
শিল্পী আবদুস কুদ্দুসের আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো না। যৎসামান্য ভাতা পান। কিন্তু তা অপ্রতুল। শুধু নিজের একার আগ্রহে পুতুলনাচের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে মনহারা দলটি পরিচালনা করে যাচ্ছেন এই শিল্পী।সুজন রহমান, জেলা কালচারাল অফিসার, কুষ্টিয়া
পুতুলনাচের পালায় এখন যে আর আগের মতো দর্শক নেই, এ পরিবর্তন মানতে কষ্ট হয় আবদুস কুদ্দুসের। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘মনহারা পুতুলনাচের দল চালু হয় পাকিস্তান আমলে। শুকচান মাল নামের একজন এই দল গড়েন। শুকচান ছিলেন আমার ওস্তাদ। তাঁর কাছেই হারমোনিয়াম বাজানো, গান গাওয়া, পুতুলনাচ দেখানো শিখেছি।’
১৯৭২ সালে শুকচানের মৃত্যুর পর থেকে মনহারা পুতুলনাচের দল চালাচ্ছেন আবদুস কুদ্দুস।
আবদুস কুদ্দুসের তিন মেয়ে—ডালিয়া, বেদানা আর আঙুরি। মেজ মেয়ে বেদানা খাতুন থাকেন বাবার বাড়িতে। বাকি দুই মেয়ের পৃথক সংসার আছে। বেদানার বিয়ে হয়েছিল ১৮ বছর আগে। তখন তিনি ছিলেন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
বেদানা খাতুন প্রথম আলোকে বললেন, ‘বিয়ের পর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভরসা দেয় নাই কেউ। একটা ছেলেসন্তান হয়। কিন্তু ভাগ্য খারাপ থাকলে যা হয়, ছয় বছরের মতো সংসার করার পর স্বামী মারা যায়। বাবার বাড়ি ফিরে আসি। পুতুলনাচ দেখায়ে আর কয় টাকা আয় করেন আব্বা। তাই সেলাইয়ের কাজ শিখছি। পড়ালেখাও করছি।’
বেদানা এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। বেদানার ছেলে সোহানুর রহমানের বয়স এখন ১৫ বছর। নানার সঙ্গে সে–ও ভিড়েছে পুতুলনাচের দলে। বেদানা জানান, বাবার সব পুতুলের পোশাক সে নিজেই বানিয়ে দেয়। ছোট ছোট ঘাগরা, ফতুয়া, শাড়ি, ব্লাউজ, ছেলেদের পোশাক—সবই বানাতে হয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র যেন একটি বাস্তব চরিত্র আবদুস কুদ্দুস। কুষ্টিয়ার মিরপুরে এক কামরার ঘরে থাকেন তিনি। সঙ্গী পরিবারের চার সদস্য আর মনহারার পুতুলগুলো। কিন্তু দু-একজনের সহযোগিতায় পুতুলনাচের একটা দল চালানো সম্ভব হয় না। দলটিতে ১০ জনের মতো সদস্য আছে। যা আয় হয়, সবার মধ্যে তা ভাগ করে দিতে হয়।
শিল্পী আবদুস কুদ্দুসের বয়স হয়েছে। পুতুলনাচের দিনও আগের মতো নেই। মিলছে না পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা। তবু ডাক পেলে দেশের যেকোনো জায়গায় পুতুলকে সঙ্গী করে ছুটে যান। কিন্তু এখন ডাক আসার সংখ্যাও অনেক কমে গেছে।
প্রবীণ এ শিল্পী সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয় কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানটির কালচারাল অফিসার সুজন রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের অন্যতম পুরোনো পুতুলনাচের দল আবদুস কুদ্দুসের মনহারা। স্বশিক্ষিত এই শিল্পী গান-নাচ জানেন। পুতুল বানান, খেলা দেখান, আবার পালায় অভিনয় করেন।’
৬০ বছর ধরে এই কাজ করছি। জীবনের সবটাই দিয়ে দিছি পুতুলনাচে। এত যুদ্ধ করেও কি পারলাম ভালো থাকতে? আমিও ভালো নাই, আমার পুতুলগুলাও ভালো নাই।আবদুস কুদ্দুস, পুতুলনাচশিল্পী
সুজন রহমান আরও বলেন, ‘শিল্পী আবদুস কুদ্দুসের আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো না। যৎসামান্য ভাতা পান। কিন্তু তা অপ্রতুল। শুধু নিজের একার আগ্রহে পুতুলনাচের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে মনহারা দলটি পরিচালনা করে যাচ্ছেন এই শিল্পী।’
পুতুলনাচ নিয়ে নিজের আক্ষেপের কথা বলছিলেন আবদুস কুদ্দুস। কথার ফাঁকে সুরেলা কণ্ঠে গুনগুনিয়ে গান ধরলেন, ‘তুমি ভালো করে কইরো বাতাস ও সরলা, তুমি নেচে নেচে কইরো বাতাস ও সরলা।’ পালার সময় এই গান গাইতে হয় তাঁকে। গান থামিয়ে বললেন, ‘৬০ বছর ধরে এই কাজ করছি। জীবনের সবটাই দিয়ে দিছি পুতুলনাচে। এত যুদ্ধ করেও কি পারলাম ভালো থাকতে? আমিও ভালো নাই, আমার পুতুলগুলাও ভালো নাই।’