‘পানির মধ্যে ঘুম দেই, তাই টাকা লাগে না’

কুড়িয়ে আনা সবজি গোছাচ্ছেন সুফিয়া, নুরজাহান, আফিয়া আর কমলা। ১৪ আগস্ট বিকেলে কারওয়ান বাজারে
ছবি: অগ্নিলা আহমেদ

কারওয়ান বাজারে কাজ করা নারীরা বেশ চটপটে। সারা দিন পরিশ্রম করেন। মালসামানা তোলেন, ওজন মাপেন। কখনো কখনো কাদায় আটকে যাওয়া শাকসবজি বোঝাই ভ্যানের চাকা তুলতেও দেখা যায় তাঁদের। তাঁরা মাঝেমধ্যে চা, পান খেতে সামান্য বিরতি নেন। সম্ভব হলে একে–তাকে ধরে আনিয়ে এক কাপ চায়ে সুরুত করে চুমুক দেন। যেমন আয়েশের সময় নেই, তেমনি আচরণে মাঝামাঝি ব্যাপার বলেও কিছু নেই। কাজের বাইরে কিছু জানতে চাইলেই পত্রপাঠ বিদায় করেন। মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে শুনিয়ে দেন ‘সইরা কাস্টমাররে জায়গা দেন। আলাপ পরে।’ এমন সব উপেক্ষা, অবহেলা গিলেও নিচু স্বরে ইয়ে মানে শুনছেন খালা বলে মন গলানোর চেষ্টা করতে হয়। কেউ কেউ দু–এক কথা বললেও শ্রাবণের শেষ সোমবার সন্ধ্যায় শেষ পর্যন্ত একবগ্গা ঠাকুর হয়ে রইলেন কিশোরগঞ্জের সুফিয়া বেগম। বিকেলের বৃষ্টি–কাদার ভেতর ছেঁড়া শাড়ি পরে বসে থাকা সুফিয়ার গায়ে কাদার ছড়াছড়ি। মনে হতেই পারে, কারওয়ান বাজারে গড়াগড়ি দিয়েছেন।

সুফিয়া বেগম একজন ভাগের সবজি বিক্রেতা। ফেলে দেওয়া পচা সবজি, পড়ে যাওয়া পেঁয়াজ কুড়িয়ে আনেন। তাঁকে সারা দিনই ময়লা কাদার ভেতর ঝুঁকে থাকতে হয়। সে ছাপটা স্পষ্ট সারা শরীরে। বিবিএসের দেওয়া ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ–২০২৩ (এপ্রিল-জুন) অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন মোট ৭ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজার নারী–পুরুষ কর্মক্ষেত্রে জড়িত। এর মধ্যে ২ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার নারী। এ সংখ্যার মধ্যে সুফিয়া বেগমও আছেন।

দিনশেষে সেদিন নুরজাহান বেগমের বিক্রি হয়েছিল দেড় শ টাকার সবজি। ১৪ আগস্ট বিকেলে কারওয়ান বাজারে

সুফিয়া সারা দিনের সঞ্চয় নিয়ে বসেন বিকেলে। প্রথমে হয় সবজি বাছাইকরণ এবং পৃথককরণ পর্ব। এরপর কোটাবাছা। তারপর আবার মিলিয়ে–ঝিলিয়ে ভাগ। দশ, বিশ, তিরিশ ও চল্লিশ টাকার ভাগ আছে। দাম বুঝে মাপ। কখনো যেকোনো একপ্রকার দিয়েই ভাগ, অধিকাংশ সময় কয়েক রকম মিলিয়ে। এসব দোকান থেকে অল্প আয়ের মানুষ সবজি কেনেন। সোমবার বিকেলে কারওয়ান বাজারে নারী দোকানদারদের খোঁজখবর নেওয়ার সময় একজন গোপন তথ্য দেওয়ার মতো কানের কাছে এসে বললেন, ‘মেসবাড়ির রান্নার জন্যও ভালো যায় এসব ভাগের সবজি। ছোট ছোট হোটেলওয়ালাদেরও বায়না থাকে। কতজন যে আসে কিনতে। অনেক ভালো ভালো মানুষও কইলাম খুঁজে ভাগের সবজি।’

রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা সবজি বিক্রির আড়ত কারওয়ান বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অনেক পেশার ভেতর একটি পেশা ভাগে সবজি বিক্রি। ভাগের সবজি বিক্রেতাদের অধিকাংশই বয়স্ক নারী। যাদের গ্রামের বাড়ি আছে, পরিবার আছে কিন্তু সবই নামকাওয়াস্তে। তাঁরা থাকেন ঢাকা শহরে। কালেভদ্রে যান বাড়িতে।

এমন চার নারী মিলে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে সবজি বিক্রি করছেন কারওয়ান বাজারের একটি দোকানে বসে। সমবয়সী সুফিয়া, নুরজাহান, আফিয়া আর কমলা থাকেনও একই জায়গায়। তাঁদের বাড়ি কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্থানে। কারওয়ান বাজারের মাটির মেঝের এই দোকানের ভাড়া দুই বেলা মিলে ২০০ টাকা। চারজন ৫০ টাকা করে দেন। দিনের আয় কত জানতে চাইলে সেই মারমুখী ভঙ্গিতে ফেরত গেলেন সুফিয়া। তাঁকে শান্ত করলেন সঙ্গী তিনজন। বললেন, ‘বৃষ্টিবাদলার দিন, সারাটা দিন টুকায়ে যা–ও পাইছি, কেউ কিনতে আসছে না। তাই মেজাজ ভালো না।’

তাঁরা থাকেন কারওয়ান বাজারের পেছনে কাঠপট্টি নামের এক জায়গায়। সকালের খাবার একেবারে ‘ইংলিশ ব্রেকফাস্টের’ বাংলা সংস্করণের মতো, দুধ চায়ে পাউরুটি ডুবিয়ে। দুপুর আর রাতেও হোটেল থেকে কিনে খান। কমপক্ষে ১০০ টাকা করে যায়। সোমবার দুপুরে চার নারী পাঙাশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছেন। অন্য দিন এক বেলা মাছ সস্তায় পেলে খান, না হলে ডাল আর সবজিই তাঁদের পছন্দের। একই অবস্থা কারওয়ান বাজারের অন্য পেশার নারীদেরও। অধিকাংশের রান্নাবান্না, ঘরকন্যার সুযোগ নেই।

কারওয়ান বাজারে এই সবজি বিক্রি হয় ভাগা বসিয়ে, যার একেকটির দাম রাখা হয় ১০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। বৃষ্টি বলে ক্রেতা আসেনি

ওয়াসা ভবনের দিক থেকে কারওয়ান বাজারে প্রবেশ করতে গেলে দ্বিতীয় সারিতে পাওয়া যাবে বিউটি বেগমের দোকান। গলায় রুপার চেইন পরা বিউটি বেগম হাত–পা ছড়িয়ে বসেছিলেন আয়েশ করে। তাঁর আবার একটি চোখ নষ্ট। সেটা পূরণ করেন মুখের হাসি দিয়ে। সে হাসি দেখার মতো। তাঁর দোকানে বাছাই করা আদা, রসুন থাকে বলে নিজেকে অন্যদের তুলনায় কিছুটা কুলীন ভাবেন। ছবি তুলতে চাইলে হাসিমুখে সম্মতি দিলেন এবং দেখতেও চাইলেন। মতামত দিলেন, পেছনের ছালা বস্তাগুলো চাইলেই ছবি থেকে বাদ দেওয়া যেত। তাঁর দোকানে যে এত ভালো আলু আছে, সেসব কেন ছবিতে অনুপস্থিত? বিউটি বেগমকে জবাব দিয়ে অপরাধী মুখ করে এগিয়ে যেত হলো আরেকটা দোকানে। এটা বেগুনবাড়ি বস্তির আনু বেগমের দোকান। তাঁর আবার ব্যবসার জাতপাত একেবারে স্বতন্ত্র। তিনি শুধু কাঁচকলা বিক্রি করেন। দিনে ছয় থেকে সাত হাজার টাকার কাঁচকলা কেনেন। এসব আসে ফরিদপুর, যশোর অঞ্চল থেকে। বাসায় বয়স্ক মানুষ বা কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগী থাকলে তাঁর দোকানে যোগাযোগ করতে বলেছেন। সোমবার তাঁকেও একটু বিরক্ত দেখা গেল। বললেন, মরার বৃষ্টি থামে না কেন?

মূল বাজারের লম্বা পাঁচটি সারির প্রথমটি বাদ দিয়ে বাকি চারটিতেই আছেন দুই–একজন করে নারী দোকানদার। তাদের দুই ধরন। এক দল পুঁজি খাটিয়ে নতুন সবজি কিনে বিক্রি করে। অন্য দল কুড়িয়ে যা পায় তা–ই দিয়ে ভাগের সবজি বিক্রি করে। সেসব ভাগে থাকে খোসা ছাড়ানো (খানিকটা পচে যাওয়া) তিনটি পেঁয়াজ, মুখ থুবড়ে থাকা আড়াই শ গ্রাম ঢ্যাঁড়স, পোকায় কাটা একটা বেগুন, খানিকটা করলা ইত্যাদি। অল্প আয়ের মানুষেরা এসব কিনতে আসেন। এতে দিনে সব মিলে আড়াই থেকে তিন শ টাকা আয় হয় তাদের। দোকানভাড়া আর খাওয়া বাবদ চলে যায় দুই শ টাকার মতো। বাকিটুকু তাঁর হাতে।

আনু বেগম একাই চালান তাঁর কাঁচকলার দোকান। থাকেন বেগুনবাড়ি বস্তিতে

কারওয়ান বাজারে ভাগের সবজি বিক্রেতা নারী দলের চারজনের মধ্যে সবচেয়ে গোছানো ও পরিপাটি কমলা বেগম। ছালা মেলে দেওয়া দড়ির নিচে বসে তিনি সব সবজি কুটেবেছে গুছিয়ে ফেলেছেন। সুফিয়া বেগমের সামনে তখনো রাজ্যের তরকারি স্তূপ হয়ে আছে। এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে।

আগের সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। সপ্তাহজুড়েই তা–ই হচ্ছে। এই নারী সবজি বিক্রেতাদের কাছে ঘুমানোর জায়গা নিয়ে জানতে চাইলে কাঠপট্টির কথা বলেছিলেন। সে বাবদ কত খরচ হয় জিজ্ঞেস করতেই খেঁকিয়ে উঠলেন সুফিয়া। বললেন, ‘সারা রাত পানির মধ্যে দাঁড়ায় দাঁড়ায় ঘুমাই আবার পয়সা!’

সামান্য আয়ের নারীরা আসলে যে আয় করেন, তা দিয়ে ঘরভাড়া দেওয়ার অবস্থা থাকে না। খোলা বারান্দায় শুয়ে পড়েন। বালিশ হচ্ছে, নিজের একটা হাত। বৃষ্টির ভেতর সে জায়গা ভেসে যায়। ছপছপে পানিতে ভরে যায় সবটুকু। তখন জেগে দাঁড়িয়ে থাকেন সারাটা রাত বৃষ্টি কমার আশায়।