উপজেলা পর্যায়ে ইন্টারনেট

বিটিসিএলের গ্রাহক টানতে না পারার কারণ কী

ইন্টারনেট
প্রতীকী ছবি

উপজেলা পর্যায়ের মানুষের কাছে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিতে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। প্রকল্পের আওতায় বসানো হয়েছে অপটিক্যাল ফাইবার কেব্‌ল। নেওয়া হয়েছে আরও উদ্যোগ। তবে গ্রাহক টানতে পারছে না বিটিসিএল।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) মূল্যায়ন প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে যত মানুষ ইন্টারনেট সেবা নিচ্ছেন, তার মাত্র ১১ শতাংশ বিটিসিএলের ইন্টারনেট সেবার আওতায়।

সম্প্রতি প্রস্তুত করা এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্প গ্রহণের আগে এর সম্ভাব্যতা যাচাই ও ভিত্তি জরিপ (বেসলাইন সার্ভে)—কিছুই করা হয়নি। উচ্চগতির ইন্টারনেট পেতে মানুষ যে পরিমাণ ব্যয় করছেন, সেই তুলনায় সেবা পাচ্ছেন না।

এটি অনেক আগের প্রকল্প। তাই বিস্তারিত না জেনে এটা সম্পর্কে আপাতত কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।
—আসাদুজ্জামান চৌধুরী, বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্তি দায়িত্ব)

বিটিসিএলের প্রকল্পটির নাম ‘উপজেলা পর্যায়ে অপটিক্যাল ফাইবার কেব্‌ল নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্প’। উপজেলা পর্যায়ে অপটিক্যাল ফাইবার কেব্‌ল নেটওয়ার্ক উন্নয়ন (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্পটি ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়। এ সময়ের মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফায় বাড়ানো হয়। ব্যয় হয় ৬২১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

দেশের ৩৪৫টি উপজেলায় এ প্রকল্পের কার্যক্রম চলে। উদ্দেশ্য ছিল, পল্লি অঞ্চলে প্রযুক্তিগত সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার জন্য উপজেলা পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড সংযোগ ও উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবার অবকাঠামো তৈরি করা।

গ্রাহকের আস্থা অর্জনে পিছিয়ে

বিটিসিএলের এ প্রকল্প নিয়ে আইএমইডির প্রস্তুত করা মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাড়তি ব্যয়সহ প্রকল্পটির একাধিক দুর্বল দিক রয়েছে। প্রাক্কলিত ব্যয়ের তুলনায় প্রকল্প বাস্তবায়নে ২৫ দশমিক ১৫ শতাংশ বাড়তি ব্যয় হয়েছে। অনেক জায়গায় প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত যন্ত্রপাতি আংশিক সচল অবস্থায় পাওয়া গেছে। অনেক জায়গায় অপটিক্যাল ফাইবার কেব্‌ল কাটা অবস্থায় ছিল। কোথাও কোথাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অনেক জায়গায় দক্ষ জনবল না থাকায় স্থাপিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এর প্রভাব পড়েছে গ্রাহকের আস্থায়।

সরকারি সংস্থাগুলোর সেবার মান নিয়ে সব সময়ই প্রশ্ন থাকে। তাদের সেবা সরকারি পর্যায়ের কিছু সংস্থায় থাকে, নাগরিকদের কাছে পৌঁছায় না।
—ফাহিম মাশরুর, বেসিসের সাবেক সভাপতি

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপজেলা পর্যায়ে ৮৯ শতাংশ গ্রাহক বেসরকারি ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করেন। বিটিসিএলের গ্রাহক মাত্র ১১ শতাংশ। এর অর্ধেকের বেশি বেসরকারি ইন্টারনেট সেবা নেয়। কেননা, সক্ষমতার অভাবে উপজেলা পর্যায়ে বিটিসিএলের ইন্টারনেট–সংযোগ প্রায়ই বন্ধ থাকে। দীর্ঘ সময়েও এর সমাধান হয় না। তাই গ্রাহকেরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

ব্যয়ের বিপরীতে আয় কম

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি গ্রহণের আগে কোনো নিরপেক্ষ ও পেশাদার সংস্থাকে দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করেনি বিটিসিএল। করা হয়নি ভিত্তি জরিপ বা বেসলাইন সার্ভে। ফলে প্রকল্পের আওতায় স্থাপন করা কেব্‌ল ও যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়সাশ্রয়ী ও বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা দেখা যায়নি। গ্রাহকসেবায় বাণিজ্যিক পরিকল্পনাও ছিল না। এসব কারণে মানুষ যে পরিমাণ ব্যয় করছেন, সেই পরিমাণ সুফল পাচ্ছেন না। অন্যদিকে ব্যয়ের বিপরীতে পর্যাপ্ত আয় করতে পারছে না বিটিসিএল।

এ ছাড়া বিটিসিএলের এ প্রকল্পের মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হলেও যথাযথ বাণিজ্যিক পরিকল্পনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রচারণার অভাবে তা গ্রহণ করা যাচ্ছে না—এমনটাই বলা হয়েছে আইএমইডির প্রতিবেদন। প্রকল্পটির পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় এবং এই ব্যয়ের বিপরীতে আয়সংক্রান্ত কোনো তথ্য বিটিসিএলের কাছে পায়নি আইএমইডি।

ঘাটতি রয়েছে জনবলে

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি গ্রহণের সময় বিটিসিএল জানিয়েছিল, নিজস্ব জনবল দিয়ে তারা এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। অর্থাৎ, অপটিক্যাল ফাইবার কেব্‌ল ও স্থাপন করা যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ এবং গ্রাহকসেবা—দুটিই দেওয়া হবে নিজস্ব জনবল দিয়ে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। প্রকল্পে নিয়োজিত ঠিকাদারের কর্ম ও পরিকল্পনায় ঘাটতি দেখা গেছে।

এ ছাড়া তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের ইনফো সরকার প্রকল্পগুলোর (১,২,৩) সঙ্গে বিটিসিএলের এ প্রকল্পের কাজের মিল রয়েছে। তাই মাঠপর্যায়ে একই ধরনের কাজ বাস্তবায়নের ঝুঁকি রয়েছে।

আইএমইডির সুপারিশ

ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের আগে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সুপারিশ করেছে আইএমইডি। প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, বিটিসিএলের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রচারণা বাড়ানো, গ্রাহকবান্ধব সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে সঙ্গে নেওয়া, কোনো কারণে কেব্‌ল ক্ষতিগ্রস্ত হলে দ্রুত তা মেরামত করা অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া প্রকল্পটির বর্তমান অবস্থা জানার জন্য নিরপেক্ষ ও পেশাদার সংস্থার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা চালানোর সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

আইএমইডির প্রতিবেদন ও সুপারিশের বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্তি দায়িত্ব) আসাদুজ্জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি অনেক আগের প্রকল্প। তাই বিস্তারিত না জেনে এটা সম্পর্কে আপাতত কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোর সেবার মান নিয়ে সব সময়ই প্রশ্ন থাকে। তাদের সেবা সরকারি পর্যায়ের কিছু সংস্থায় থাকে, নাগরিকদের কাছে পৌঁছায় না। আইএমইডির প্রতিবেদনও যেহেতু বলছে, তাই বেসরকারি খাতে এগুলো ছেড়ে দেওয়া উচিত। সরকার নীতিগত সহায়তা দেবে।

প্রকল্পটির ভালো দিক সম্পর্কে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পের আওতায় দেশের ৩৪৩টি উপজেলাকে অপটিক্যাল ফাইবার কেব্‌ল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। ফলে এসব উপজেলায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।