মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত বছর পরেও বাংলাদেশে একটি সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। সেখানে ‘মুক্তির গান’ আমাদের গৌরবকাহিনির সংরক্ষিত এক প্রত্নতত্ত্ব।
মুক্তির গান নিয়ে এ পর্যালোচনা উঠে আসে ‘মুক্তির গান, ইতিহাসের মঞ্চায়ন এবং দর্শকের বিশ্বাস’ শিরোনামের আলোচনায়। বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের উদ্যোগে ১৭তম বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসব ঢাকা, ২০২৪–এর আলমগীর কবির স্মারক বক্তৃতার অংশ ছিল এ আয়োজন।
আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রে আয়োজিত হয় এই আলোচনা অনুষ্ঠান। এবারের স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসবের স্লোগান ‘১৯৭১ থেকে ২০২৪ আমরা সব সময়ই আমাদের অধিকারের জন্য সোচ্চার’।
প্রধান আলোচক যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যকলা বিভাগের শিক্ষক নাঈম মোহায়মেন মুক্তির গান চলচ্চিত্রের বিভিন্ন অংশ নিয়ে আলোচনা করেন। সেখানে কারিগরি প্রসঙ্গের সঙ্গে উঠে আসে ইতিহাস পুনর্নির্মাণ এবং দর্শকের প্রত্যাশার কথা।
নাঈম মোহায়মেন বলেন, গত শতকের নব্বইয়ের দশকে মার্কিন তথ্যচিত্র নির্মাতা লেয়ার লেভিনের কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও ফুটেজকে তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ ব্যবহার করে ইতিহাস সংরক্ষণ করেছেন। লেয়ার লেভিনের ফুটেজে সম্পাদনা করে এর সঙ্গে নতুন দৃশ্য সংযোজন করে মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ সময়কাল ধরতে চেষ্টা করেছেন।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরও বলেন, মুক্তির গান চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক রকম আলোচনা গবেষণাই বরং মুক্তিযুদ্ধকে আরও বেশি বুঝতে সাহায্য করবে। মুক্তির গানের পর আসে ‘মুক্তির কথা’ ও ‘নারীদের কথা’ চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ। মুক্তির গান ব্যাপারটাই এত শক্তিশালী ছিল যে এটার ওপর ভিত্তি করে তারেক মাসুদ ও ক্যাথারিন মাসুদ কয়েকটি চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র করেছেন।
এ সময় মুক্তির গান চলচ্চিত্রের কিছু কাঠামোগত দিক নিয়ে আলোচনা করেন নাঈম মোহায়মেন। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত বছর পরও একটি সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি বাংলাদেশে। সেখানে ‘মুক্তির গান’ হচ্ছে আমাদের গৌরবকাহিনির সংরক্ষিত এক প্রত্নতত্ত্ব।’
তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদের এই চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর জন্য ঘুরে বেড়ানোর সময়কাল নিয়ে কথা বলেন তারেক মাসুদের ছোট ভাই নাহিদ মাসুদ। তিনি বলেন, মুক্তির গান প্রদর্শনের সময় আক্ষেপ ছিল তাদের। তাঁরা ভাবতেন এই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি শ্রেণির জন্য প্রতিনিধিত্ব করে তা স্পষ্ট হলো। মুক্তিযুদ্ধ যে সর্বজনীন যুদ্ধ ছিল সে বার্তাটি পৌঁছে দেওয়া গেল না।
একাত্তরে রণাঙ্গনে যখন তুমুল যুদ্ধ চলছে, তখন ভিন্ন রকম আরেক যুদ্ধে নেমেছিলেন একদল তরুণ সংস্কৃতিকর্মী। তাঁদের একমাত্র অস্ত্র ছিল গান। একটি ট্রাকে করে শরণার্থীশিবির থেকে শরণার্থীশিবিরে ছুটে বেরিয়ে তাঁরা শুধু গান গেয়ে লড়াই-সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছেন মানুষকে। সংস্কৃতিকর্মীদের এসব কর্মকাণ্ডের কাহিনি ফুটে উঠেছে এক মর্মস্পর্শী চলচ্চিত্রে, যার নাম মুক্তির গান।
শিল্পী ঢালী আল মামুনের বক্তব্যে উঠে আসে ১৯৯৪ সালে এই চলচ্চিত্রের জন্য জার্মান সংবাদ মাধ্যম/সংস্থা ডয়চে ভেলের আর্কাইভ থেকে সংগ্রহ করা কালুরঘাটে স্বাধীনতা ঘোষনার অডিও। ওই সময় এ শিল্পী ছিলেন জার্মানিতে। তিনিও এই সংগ্রহ কাজের সঙ্গে যুক্ত হন।
ঢাকা ডক ল্যাব আয়োজক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা তারেক আহমেদ বলেন, ‘মুক্তির গান’ বাংলাদেশের তথ্যচিত্র তৈরির ক্ষেত্রে আইকন, মাইলস্টোন।
শ্রোতাদের প্রশ্নোত্তর পর্ব থেকে উঠে আসে মতামত। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সভাপতি জহিরুল ইসলাম।
এবারের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবটি সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সিটি ব্যাংক পিএলসির আর্থিক সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভেন্যু পার্টনার হিসেবে আছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।