মজিবুর রহমান সরকার গত ২১ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান
মজিবুর রহমান সরকার গত ২১ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান

বাসা থেকে বের হওয়ার ৩৫ মিনিটের মধ্যে লাশ হয়ে ফেরেন মজিবুর

স্থানীয় একটি মসজিদে আসরের নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কদমতলী এলাকার বাসিন্দা মজিবুর রহমান সরকার। সেখান থেকে বের হতেই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। এ সময় একটি গুলি এসে লাগে তাঁর বুকে। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। পরে এলাকাবাসী ভ্যানে করে তাঁকে বাসায় নিয়ে আসেন। বাসা থেকে বের হয়ে ৩৫ মিনিটের মধ্যে লাশ হয়ে বাসায় ফেরেন মজিবুর।

গত ২১ জুলাই ঘটে যাওয়া ঘটনাটির এভাবেই বর্ণনা দেন মজিবুর রহমানের স্ত্রী নুরুন নাহার। সেদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন মজিবুর রহমান। তাঁর বুকের বাঁ পাশে গুলি লাগে। কোনো চিকিৎসারও সুযোগ পাননি, গুলি লাগার পরপরই মারা যান তিনি।

কদমতলীর তুষারধারা আবাসিক এলাকায় বাবার বাসায় বসে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন নুরুন নাহার। তিনি বলেন, ২১ জুলাই কারফিউ চলছিল। তবে এলাকায় মানুষের উপস্থিতি ভালোই ছিল। এলাকায় পুলিশ ঢুকে পড়লে বিকেলে পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে।

নুরুন নাহার বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর লাশ নিয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ারও সাহস পাননি। পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা সম্ভব হয়নি। মারা যাওয়ার খবর পেয়ে একটু দূরে থাকা স্বজনেরাও আসতে পারেননি। সবকিছুই খুব তাড়াহুড়ো করে শেষ করতে হয়েছে। তুষারধারা আবাসিক এলাকার কবরস্থানেই মজিবুরকে দাফন করা হয়। এলাকাবাসীই তাঁর দাফনের ব্যবস্থা করেন।

স্ত্রী ও ছেলে–মেয়ের সঙ্গে মজিবুর রহমান সরকার

মজিবুর রহমান সরকার-নুরুন নাহার দম্পতির বিয়ে হয় ১৯৯৪ সালে। তাঁরা সম্পর্কে চাচাতো ভাই-বোন। এই দম্পতির দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে মারোয়া রহমান স্নাতকোত্তর করছেন। আরেক মেয়ে মাইমুনা রহমান স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ছেলে মাহিবুর রহমান নবম শ্রেণিতে পড়ছে।

দীর্ঘ ২৫ বছর মজিবুর রহমান সৌদি আরবে ছিলেন। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় তিনি দেশে চলে আসেন। শ্বশুরের বাসার কাছেই নিজেদের বাড়ির কাজে হাত দিয়েছিলেন মজিবুর। এর মধ্যে তিনটি ফ্ল্যাটের কাজ শেষ হওয়ার পর ভাড়াও দিয়েছেন। কিন্তু নিজেদের ফ্ল্যাটটির কাজ চলছিল। তাই নুরুন নাহার স্বামী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে মায়ের সঙ্গে মায়ের বাসাতেই থাকতেন।

নুরুন নাহার বলেন, ২১ জুলাই মজিবুর রহমান বাসার বাজার করেন। দুপুরে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেন। এরপর আসরের নামাজ পড়তে বের হন। কিছু সময় পর হঠাৎ বাসার নিচে চিৎকার শুনে বারান্দায় গিয়ে তিনি দেখেন ভ্যানে স্বামীর রক্তাক্ত লাশ।

মাত্র সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় নুরুন নাহারের বিয়ে হয়। প্রবাসী স্বামী দেড়–দুই বছর পরপর এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসতেন। তবে করোনার সময় স্বামী একেবারে দেশে চলে আসার পরই মূলত তাঁদের পুরোদমে সংসার শুরু হয়েছিল।

নুরুন নাহার বললেন, ‘আমরা নতুন করে সংসার করা শুরু করেছিলাম। ছেলেমেয়েরা তাদের বাবাকে চিনতে শুরু করেছিল। পুলিশের গুলিতে সব শেষ হয়ে গেল। আমার স্বামী টেলিভিশনে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের খবর দেখতেন। ছেলেটাও আন্দোলনে যেত না। তাই আন্দোলনে আমার পরিবারের কেউ গুলিতে মারা যাবে, তা নিয়ে চিন্তা করিনি।’

নুরুন নাহারের সঙ্গে দুই মেয়ে

বাবাকে নিয়ে মারোয়া ও মাইমুনা বললেন, তাঁরা ছোটবেলা থেকেই সেই অর্থে বাবার সঙ্গ পাননি, আদর পাননি। ছুটিতে যখন দেশে আসতেন প্রথম দিকে বাবার সঙ্গে একটু দূরত্ব থাকত। আর যখন বাবার সঙ্গে মিশতে শুরু করতেন তত দিনে বাবার চলে যাওয়ার সময় হয়ে যেত। করোনার পর বাবা দেশে চলে আসার পর বাবা-মেয়েদের সম্পর্ক সহজ হওয়া শুরু করেছিল। এখন তো গুলি বাবাকে কেড়ে নিল। চাইলেও বাবার সম্পর্ক ভালো করার কোনো সুযোগ নেই।

মাইমুনা রহমান বললেন, ‘ছোটবেলায় বাবার আদর পাইনি। বড় হয়ে আদর পাব, তা–ও আর হলো না।’

নুরুন নাহার বললেন, স্বামীর বাসা থেকে বের হওয়া, লাশ হয়ে ফেরা—সব মিলে ৩৫ মিনিটের মধ্যেই তাঁর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। তিনি স্বামী হত্যার জন্য কারও কাছে আর্থিক কোনো সহযোগিতা চান না, শুধু এর সুষ্ঠু বিচার চান। নুরুন নাহারের প্রশ্ন, ‘একজন মানুষ নামাজ পড়তে বের হয়ে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরবে কেন?’