যে চাকরির কথা বলে বিদেশে নেওয়া হয়, সেই চাকরি তাঁরা পাননি। যে বেতনের কথা বলা হয়, সেই বেতনও দেওয়া হয়নি। বাধ্যতামূলকভাবে শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজ করানো হয়েছে। চলেছে নির্যাতন।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) এবং মাইগ্র্যান্ট ফোরাম ইন এশিয়া (এমএফএ) আয়োজিত ‘মজুরি চুরি বিষয়ে অভিবাসী শ্রমিকদের গণসাক্ষ্য’-বিষয়ক অনুষ্ঠানে বিদেশ ফেরত শ্রমিক ও আলোচকেরা এসব তথ্য তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে সৌদি আরব, দুবাই, লেবানন থেকে করোনাকাল ও এর আগে ফিরে আসা ১২ জন শ্রমিক তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তাঁরা দেশ থেকে যাওয়ার সময় স্থানীয় দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছিলেন।
প্রবাসী শ্রমিকেরা বলেন, শর্ত অনুযায়ী তাঁরা ছুটি পান না। আলোচনা ছাড়াই যখন-তখন বেতন কমানো হচ্ছে। এ ছাড়া বিমা, চিকিৎসা, পরিবহন খরচ ও দক্ষতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণের অজুহাতে শ্রমিকদের বেতনের টাকা কেটে রাখছেন মালিকেরা। যা পরবর্তীতে আর ফেরত পাচ্ছেন না তাঁরা। চাকরি, মজুরি ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের যেসব শর্ত রয়েছে, তার অধিকাংশই মানা হচ্ছে না। আর এভাবেই মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসী শ্রমিকদের মজুরি চুরির ঘটনা ঘটছে।
প্রবাসী শ্রমিকেরা বিদেশে গিয়েও শারীরিক নির্যাতন, না খেয়ে দিন কাটানো, ৮ ঘণ্টার জায়গায় ১৮-১৯ ঘণ্টা কাজ করা, মাসের পর মাস বেতন না পেয়ে দেশে থাকা পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে টিকিট কেটে ফিরে আসার রোমহর্ষ বর্ণনা জানান।
এ রকম শ্রমিকদের একজন কুমিল্লা এলাকার বাসিন্দা এক নারী শ্রমিক। তাঁকে মেডিকেল ভিসার কথা বলে কুমিল্লা ওভারজিসের মাধ্যমে সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছিল । দেড় লাখ টাকা খরচ করে সেখানে গিয়ে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে গৃহিণীর। তিন মাস কাজ করে কোনো বেতন পাননি।
ওই নারী শ্রমিক বলেন, ‘খাবার তো দূরের কথা, তাঁরা (সৌদি মালিক) আমাকে ঘুমাতে দিতেন না। আট ঘণ্টা কাজের কথা বলে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত আমাকে দিয়ে কাজ করিয়েছেন।’ তাঁকে সেখানে নির্যাতন করা হতো। তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্টে দেশে ফিরে এসে কুমিল্লা ওভারসিজের মালিকের বিরুদ্ধে বিএমইটিতে অভিযোগ করেছিলাম। ক্ষতিপূরণ বাবদ মালিক মাত্র ৩০ হাজার টাকা দিয়েছে। বাকি টাকা আজও ফেরত পাইনি।’
একই রকমের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন আরেক নারী শ্রমিক। কুমিল্লার এই নারী ২৫ হাজার টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে এক মাস কাজ করেছিলেন। দিনে মাত্র দুটি রুটি খাবার দেওয়া হতো তাঁকে। এক মাস কাজ করার পর কোনো বেতন না দিয়ে দালাল চক্রের সদস্যেরা তাঁকে আটক করে একটি কক্ষে রাখেন।
তাঁকে সেখানে নির্যাতন করা হয়। সেখান থেকে পরিবারের কাছে ফোন করিয়ে ৩ লাখ টাকা দাবি করেন। পরে বাসা থেকে ২৫ হাজার টাকা নিয়ে বিমানের টিকিট কেটে দেশে ফিরে আসেন তিনি।
৫ লাখ হাজার টাকা খরচ করে লেবানন যান কেরানীগঞ্জের ওমর ফারুক। সেখানে ১১ বছর কাজ করে করোনাকালে দেশে ফিরে আসেন। গতকাল তিনি বলেন, ‘বেতন থেকে বিমা, চিকিৎসা খরচ ও পরিবহন খরচ বাবদ যে টাকা কেটে রাখা হয়েছিল, দেশে ফিরে আসার সময় সে টাকা আমাকে দেওয়া হয়নি।’
অনুষ্ঠানে রামরুর নির্বাহী পরিচালক সি আর আবরার প্রবাসী শ্রমিকদের মজুরি চুরি ধারণাপত্র পড়ে শোনান। তিনি বলেন, ‘২০২১ ও ২০২২ সালে ভারত, ফিলিপাইন,নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে বিভিন্ন সংস্থার করা গবেষণায় প্রবাসী শ্রমিকদের মজুরি চুরির বিষয় ওঠে আসে। এসব গবেষণার ভিত্তিতে আমরা বলছি, এটা একটা কাঠামোগত মজুরি চুরি।’
সি আর আবরার আরও বলেন, ২০২১ সালে গ্লোবাল কমপ্যাক্ট অন মাইগ্রেশন স্বাক্ষরিত হয়, যা এখন পর্যন্ত অভিবাসনের সবচেয়ে বড় চুক্তি। সেখানে প্রতিবেদনের দুটি জায়গায় মজুরি চুরির বিষয় উঠে আসে, যা একটা সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
ধারণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রবাসী শ্রমিকেরা মৃত্যুর পরও তাঁদের মজুরি এবং প্রাপ্য অধিকার কেড়ে নেওয়া থেকে রেহাই পান না। কারণ, এ ধরনের অভিযোগ করতে যে বিশাল আইনি খরচ রয়েছে, সেটি তাঁদের ঢাল হিসেবে কাজ করে। মজুরি চুরির কারণে যে ক্ষতি, তা কেবল অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মজুরি চুরি দেশের মোট দেশজ উন্নয়নের (জিডিপি) ওপর একটি আক্রমণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা আখ্যায়িত করেছেন।
অনুষ্ঠানে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেন, ঢাকায় বসে একজন ২০ হাজার টাকা বেতনের চুক্তি করেন, বিদেশে গিয়ে তিনি বেতন পান ১০ হাজার টাকা। এই টাকায় কাজ করতে না চাইলে পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর ওই প্রবাসী শ্রমিক অবৈধ হয়ে গ্রেপ্তার হন।
নিজামুল হক নাসিম বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের মালিকদের ধারণা, শ্রমিক হিসেবে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কোনো অধিকার নেই। আমরা প্রবাসীদের উপার্জন নিয়ে গর্ব করি। কিন্তু শ্রমিকেরা সেখানে কীভাবে কাজ করছেন, সেই বিষয়ে খবর রাখি না। আবার সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ভয়ে ওই সব রাষ্ট্রের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে সরকার কথা বলে না। প্রবাসীদের যে পাওনা রয়েছে, সেটা আদায়ে সরকারের করণীয় রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, প্রবাসীদের আয়ের উল্লাসের পাশে মজুরি চুরির মতো কষ্ট ও বেদনা রয়েছে। এই অবিচার চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, যাওয়ার খরচ নিয়ে প্রতারণা, মজুরি চুরি, মজুরি দাসত্ব ও প্রতিকারহীনতা।
হোসেন জিল্লুর রহমান আরও বলেন, ভিসা ব্যবসার নামে দুই দেশে দুষ্ট চক্র গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া তাঁরা বলীয়ান হচ্ছেন। এসব দুষ্টচক্রের কারণে বৈধভাবে বিদেশে গিয়ে অবৈধ হচ্ছেন প্রবাসীরা।
করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসী শ্রমিকদের সাহায্যে ‘কোভিড জাস্টিস ফান্ড ফর মাইগ্র্যান্ট’ গঠনের দাবি জানিয়ে হোসেন জিল্লুর রহমান আরও বলেন, এ বিষয় নিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করতে হবে।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, কাঠামোগত মজুরি চুরি হচ্ছে, এটা আরও বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশে ফিরে আসা শ্রমিকদের কথায়। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন প্রবাসী ৮-১০ জন শ্রমিকের মরদেহ দেশে আসে। গত ১৪ বছরে ৪৫ হাজার লাশ আমরা গ্রহণ করেছি।’