সন্তান ও অভিভাবক সম্মেলনে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে আনু মুহাম্মদসহ অন্যরা। শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে
সন্তান ও অভিভাবক সম্মেলনে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে আনু মুহাম্মদসহ অন্যরা। শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে

গণ–অভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকা এখনো কেন অসম্পূর্ণ

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনো হয়নি। আন্দোলনে যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁরাও এখনো রাষ্ট্রের পুরো দায়িত্বের মধ্যে আসেননি। শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ আছেন। অনেক পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন, নয়তো হাত, পা ও চোখ হারিয়েছেন। তাঁদের অবস্থা শোচনীয়। কিন্তু তাঁদের দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের নেওয়ার কথা।

শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে এক সম্মেলনে এ কথাগুলো বলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের পাশাপাশি শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের দাবিতে এ সম্মেলনের আয়োজন করে ‘সন্তান ও অভিভাবক ফোরাম’। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ।

সম্মেলনে সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, তালিকা করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ৫৩ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যথাযথভাবে হয়নি। গত সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় এমন নামও দেখেছি, যাঁদের মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্মই হয়নি। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তালিকা থেকে হারিয়ে গেছেন। জীবন দুর্বিষহ হয়েছে; কিন্তু রাষ্ট্র থেকে তাঁরা কোনো সহায়তা পাননি। আমরা নিশ্চয়তা চাই যে এর পুনারাবৃত্তি হবে না। এ কারণে বারবার তালিকার কথা আসছে। তিন মাস পরেও সরকারের অগ্রাধিকারের কাজটা যথাযথভাবে পালিত হয়নি।

আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য আবেদন করতে হচ্ছে কেন প্রশ্ন তুলে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। নতুন করে হাজার হাজার কোটি টাকা ছাপানোও হচ্ছে। অভ্যুত্থানে নিহত দুই হাজার ব্যক্তির পরিবার ও ১৯ হাজারের বেশি আহত ব্যক্তি এবং তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো তো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

আনু মুহাম্মদ বলেন, তালিকা করে শহীদ পরিবার ও আহতদের দায়িত্ব নেওয়া, নিত্যপণ্যের দাম কমানো ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা— এই তিন অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে সরকারকে দুর্বল মনে হয়েছে। যে আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি, তা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ’২৪–এর গণ–অভ্যুত্থান হচ্ছে একাত্তরের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার একটা বড় পর্ব।

সম্মেলনের প্রধান অতিথি সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ তালিকা প্রসঙ্গে বলেন, আমরা প্রথম দেড় মাস তালিকা তৈরি করেছি। সেটি অসম্পূর্ণ ছিল। ওয়েবসাইটে সবাই সাড়া দিতে পারেনি। তালিকা এখনো নিখুঁত হয়নি। আমরা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তা পূরণে কাজ করছি। জুলাই ফাউন্ডেশন হয়েছে। আমাদের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকতে পারে। তবে চেষ্টায় কমতি নেই।

শারমিন মুরশিদ আরও বলেন, আমি ১৯৭১ ও ২০২৪ দুটিই দেখেছি। যে তরুণসমাজ মৃত্যুকে ভয় পায় না, পুরো বিশ্ব তাদের ভয় পাবে। তোমরা একাত্তরেরই ধারক। বর্তমান সরকার সাময়িক সময়ের জন্য দায়িত্ব নিয়েছে। আমরা কিন্তু ক্ষমতা নিইনি বা বসিনি, আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। সেটা গুরুত্বসহকারেই নিয়েছি। এবার মেরামত, সংস্কার, পুনর্গঠন করতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, যাঁদের আত্মত্যাগে এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা, যাঁরা শহীদ বা আহত, সরকারকেই তাঁদের দায়িত্ব নিতে হবে। এখানে এসব দাবি কেন জানাতে হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের সুব্যবস্থা সরকার করুক। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধি যেন আমাদের বার্তা পৌঁছে দেন।

দেশের মানুষের মধ্যে যেন বিভেদ তৈরি না হয়, দূরত্ব না বাড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক করেন বিভিন্ন পেশার মানুষদের নিয়ে বিএনপির দলীয় পরামর্শক গোষ্ঠী জি-৯ বা গ্রুপ-২০০৯–এর সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন সায়ন্ত। তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে দূরত্ব হলে এর মধ্যে ফ্যাসিবাদ ঢুকে পড়বে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য সোহেল আহমেদ বলেন, বারবার এসব আত্মদানের মাধ্যমে বোঝা যায় আমরা গণতন্ত্রের কাঙাল। এবারের এই অর্জন ধরে রাখতে চাইলে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় প্রাধান্য দিতে হবে। সঠিক সময়ে তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ও অর্থসহায়তা দিতে হবে।

সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন ঢাকা মহানগরের সভাপতি মানস নন্দী, নারীপক্ষের সভানেত্রী শিরীন পারভীন হক, জাতীয় কবিতা পরিষদের আহ্বায়ক কবি মোহন রায়হান, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির তাসলিমা আখতার প্রমুখ।

সন্তান ও অভিভাবক ফোরামের পক্ষে দলিলুর রহমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি পেশ করেন। শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজন নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানান।