আইসিইউর এসি নষ্ট ও অপারেশন থিয়েটারে অক্সিজেন সরবরাহে সমস্যা দেখা দেওয়ায় দুই দিন ধরে ঢাকার জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিভিডি) অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় থাকা রোগীরা। এ ছাড়া ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এ হাসপাতালে হার্ট অ্যাটাক ও হার্টে রিং পরানোসহ হৃদ্যন্ত্রের জটিল রোগীদের রাখার করোনারি কেয়ার ইউনিটের (সিসিইউ) সব এসিও ঠিকমতো কাজ করছে না। এতে সংকটাপন্ন রোগীরা কষ্টের মধ্যে আছেন।
হাসপাতালটির উত্তর ভবনের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে রাখা হয় হৃদ্যন্ত্রের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন (কার্ডিয়াক সার্জারি), এমন রোগীদের। আজ রোববার এই ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করছেন রোগীরা। তাঁদের কেউ আড়াই মাস, কেউ দুই মাস ধরে এখানে ভর্তি আছেন। কবে অস্ত্রোপচারের জন্য ডাক পড়বে, সেই অপেক্ষায় আছেন তারা। এর মধ্যেই গতকাল শনিবার ও আজ রোববার—এই দুই দিন ধরে বন্ধ আছে কার্ডিয়াক অপারেশন থিয়েটারের কার্যক্রম।
অস্ত্রোপচারের জন্য দুই মাস চার দিন হলো এই ওয়ার্ডের ২১ নম্বর শয্যায় ভর্তি আছেন মাহবুবুর রহমান (৪০)। তাঁর হৃদ্যন্ত্রে ভালভ স্থাপন করার কথা। রাজশাহী শহরের মেহেরচণ্ডী এলাকা থেকে আসা মাহবুবুর আজ বলেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর বহুবার কর্তৃপক্ষের কাছে গেছেন অস্ত্রোপচারের তারিখের জন্য। অবশেষে আগামীকাল সোমবার তাঁর অস্ত্রোপচারের তারিখ পড়েছে। তবে এর মধ্যে জানতে পেরেছেন, আইসিইউ ও অপারেশন থিয়েটারের এসি (শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র) নষ্ট। তাই অপারেশন বন্ধ। এ কারণে আগামীকাল অস্ত্রোপচার হবে কি না, সেটা বলতে পারছেন না।
মাহবুবুরের মতো এই ওয়ার্ডের আরও চার রোগী জানান, অস্ত্রোপচারের জন্য তাঁদের দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। গরমে হাসপাতালে ঘুমানোর পরিবেশ নেই। এই ওয়ার্ডের ফ্যানগুলোও ঠিকভাবে চলছে না। গরমের কষ্ট থেকে রোগীদের রক্ষায় টেবিল ফ্যান কিনে এনেছেন অনেকে।
হাসপাতালের চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে সাতটি অপারেশন থিয়েটার আছে। সেগুলোর তিনটি অনেক দিন ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে। চারটিতে অস্ত্রোপচার হলেও দুই দিন ধরে সেগুলোও বন্ধ।
রোগীদের কথার সূত্র ধরে একই ভবনের চতুর্থ তলায় অপারেশন থিয়েটার ও কার্ডিয়াক আইসিইউর সামনে গিয়ে দেখা যায়, একদম ফাঁকা। অথচ ভবনের অন্য ফ্লোরগুলো রোগী ও তাঁদের স্বজনদের পদচারণ ছিল চোখে পড়ার মতো। জায়গাটি এমন ফাঁকা কেন, জানতে চাইলে সেখানে দায়িত্বরত আনসার সদস্য আবদুস সামাদ বলেন, এসি নষ্ট থাকায় দুই দিন ধরে অপারেশন পুরোপুরি বন্ধ। ঠিক হলে আবার অপারেশন শুরু হবে। তবে কবে ঠিক হবে, তা জানাতে পারেননি তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চিকিৎসক বলেন, ‘অপারেশন করার পর রোগীদের আইসিইউতে নেওয়া হয়। ঈদের পর থেকেই এখানকার এসিতে সমস্যা। এতে রোগীরা ঠিকভাবে ঘুমোতেও পারেন না। ফলে তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু দুই দিন ধরে আইসিইউর এসি পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে আছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আজ রাত পৌনে ১২টায় কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে এম মনজুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওটিতে অক্সিজেন সরবরাহ এবং আইসিইউর এসিতে সমস্যা হয়েছে। আমরা তা সারানোর জন্য গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করছি। আশা করছি, রাতের মধ্যেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আগামীকাল অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হবে।’
কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের অধীন এই অপারেশন থিয়েটারগুলোতে ভালভ প্রতিস্থাপন, হার্টের বাইপাসসহ হৃদ্রোগের জটিল অস্ত্রোপচার হয়। এরপর এসব রোগীকে অপারেশন থিয়েটার–সংলগ্ন আইসিইউতে নিয়ে রাখা হয়।
হার্ট অ্যাটাকের রোগী এবং ক্যাথল্যাবে হৃদ্যন্ত্রে রিং পরানোসহ হৃদ্রোগের অনেক জটিল রোগীকে রাখা হয় হাসপাতালের দক্ষিণ ভবনের নিচতলার করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ)। আর হৃদ্যন্ত্রে রিং পরানোর পর তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে থাকা রোগীদের রাখা হয় এই ভবনের দোতলার হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ)।
আজ বিকেলে সিসিইউতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো কক্ষ সংকটপূর্ণ রোগী দিয়ে ভর্তি।
জায়গার সংকুলান না হওয়ায় মেঝেতেও রোগী রাখা হয়েছে। কক্ষটি শীততাপনিয়ন্ত্রিত হলেও ভেতরের তাপমাত্রার কারণে তা বোঝার উপায় ছিল না। ওপরে চলছিল সিলিং ফ্যান। এরপরও রোগীদের গরম থেকে বাঁচাতে ছোট টেবিল ফ্যান কিনে এনে চালাতে হচ্ছে স্বজনদের। বড় আকারের কক্ষটিতে বেশ কয়েকটি এসি থাকলেও সেগুলোর সব কটি কাজ করছিল না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি এখানকার এসির তার চুরি হয়। এরপর এত দিনেও তা সারানো হয়নি।
সিসিইউর ২১ নম্বর শয্যায় ভর্তি আছেন নোয়াখালীর সেনবাগের মনোয়ারা বেগম (৬৫)। তাঁর পাশেই একটি হলুদ রঙের টেবিল ফ্যান চলছিল। এসি কক্ষেও কেন ফ্যান চালাতে হচ্ছে, জানতে চাইলে সঙ্গে থাকা তাঁর ননদ রশীদা বেগম বলেন, ‘এসি নামে চলছে। গরমে রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। এ কারণে বাইরে থেকে ফ্যান কিনে এনেছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দীন আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিসিইউর দুটি এসির তার চুরি হওয়ায় সেগুলো নষ্ট হয়েছে। আজই ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা।’
প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করতে দেখা গেছে ভবনটির দ্বিতীয় তলার এইচডিইউতে থাকা রোগীদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানে কর্তব্যরত এক নার্স বলেন, ‘করোনার আগে এইচডিইউতে এসি ছিল। পরে তা নষ্ট হয়। গত বছর নষ্ট এসিগুলো খুলে নিলেও নতুন এসি আর লাগানো হয়নি। গরমে অনেক বেশি ঘাম ঝরায় রোগীদের কারও কারও রক্তচাপ কমে যাচ্ছে।’
এইচডিইউতে কথা হয় ৫০ বছর বয়সী সাইফুল এনামের সঙ্গে। আজ হৃদ্যন্ত্রে একটি রিং পরানোর পর তাঁকে এইচডিইউর ৮ নম্বর শয্যায় এনে রাখা হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিং পরানোর পর অবজারভেশনের জন্য আমাকে এখানে রেখেছে।
অথচ একটু বিশ্রাম নেওয়া তো দূরে থাক ঘামে আমার পুরো শরীর ভিজে গেছে।’
এসিগুলো মেরামত করে এখানে কেন আবার দেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে পাল্টা প্রশ্ন করে হসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘আমি কি পুরো হাসপাতালে এসি করে চালাতে পারব?’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই হাসপাতালের এক চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও এইচডিইউতে থাকা রোগীদের ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় রাখা হয় না। অথচ এখানে রোগীদের ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হচ্ছে। সামান্য কিছু টাকা ও উদ্যোগের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীরা আরও ঝুঁকিতে পড়ছে।’