নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদন

জ্বালানি তেলের দাম কমার ধারা কতটা দীর্ঘস্থায়ী

যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসোলিনের দাম দাঁড়িয়েছে প্রতি ইউনিট ৪ ডলারের নিচে। জেট ফুয়েল ও ডিজেলের দামও কমছে। এর অর্থ হচ্ছে, খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে বিমানের টিকিট—সবকিছুরই দাম কমবে।

  • এখনই উল্লাস করা সংগত হবে না।

  • জ্বালানির দাম যেমন খুব সহজেই কমতে পারে, তেমনি বাড়তেও পারে।

  • তেলের দাম সব সময় মানুষকে বিস্মিত করার সক্ষমতা রাখে।

  • চীন একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য দ্বার আরও খুলে দেবে, এতে চাহিদা বাড়বে।

  • তেলের দাম বাড়লে অন্য সবকিছুর দাম বাড়ে এবং অর্থনীতি চাপের মুখে পড়ে, কখনো কখনো এর রাজনৈতিক পরিণতিও দেখা যায়।

  • ভিন্ন ধরনের শর্তের ওপর তেলের দাম নির্ভর করে, তাই তেলের দাম নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা বোকার কাজ।

  • মানুষ ক্রমেই জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, দীর্ঘ মেয়াদে জীবাশ্ম জ্বালানির দাম কমবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অনেক জ্বালানিবিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ২০০ ডলারে উঠতে পারে। তেলের দাম প্রকৃত অর্থেই প্রতি ব্যারেল ২০০ ডলারে উঠলে জাহাজভাড়াসহ পরিবহন খরচ রীতিমতো আকাশে উঠে যেত। বৈশ্বিক অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যেত।

কিন্তু তেলের দাম এখন প্রাক্‌–যুদ্ধ পর্যায়ে নেমে গেছে, গত দুই মাসেই দাম কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি। এরপর সোমবার জানা গেল, চীনা অর্থনীতির গতি কমে গেছে এবং গতি ফেরাতে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার হ্রাস করেছে। এ খবরে তেলের বাজারে আমেরিকান বেঞ্চমার্ক হিসেবে পরিচিত ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম প্রতি ব্যারেল ৯০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

অন্যদিকে গ্যাসোলিনের দাম গত ৯ সপ্তাহে প্রতিদিনই কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসোলিনের দাম দাঁড়িয়েছে প্রতি ইউনিট ৪ ডলারেরও নিচে। জেট ফুয়েল ও ডিজেলের দামও কমছে। এর অর্থ হচ্ছে, খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে বিমানের টিকিট—সবকিছুরই দাম কমবে।

আমি মনে করি, তেলের দাম আরও কমতে পারে। বেশ কিছু বিষয় একসঙ্গে ঘটছে, তৃতীয় প্রান্তিকে চীন অপরিশোধিত তেল আমদানি হ্রাস করছে, গ্যাসোলিনের মৌসুম শেষ হচ্ছে; অর্থনৈতিক শ্লথগতি নিয়ে উদ্বেগ আছে, যদিও সরবরাহ যথেষ্ট
ইএসএআই এনার্জির প্রেসিডেন্ট সারাহ্ এমারসন

কিন্তু এখনই উল্লাস করা সংগত হবে না। কারণ, জ্বালানির দাম যেমন খুব সহজেই কমতে পারে, তেমনি বাড়তেও পারে।

চীনে এখনো কোভিডজনিত বিধিনিষেধ আছে। তারা একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য দ্বার আরও খুলে দেবে। এতে চাহিদা বাড়বে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস স্ট্র্যাটেজিক পেট্রোলিয়াম রিজার্ভ থেকে তেল উত্তোলন শেষ হবে আগামী নভেম্বর মাসে। তখন এই ভান্ডার আবার ভর্তি করতে হবে, অর্থাৎ তেলের চাহিদা বাড়বে।

সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন হারিকেনের কারণে হুস্টন শিপ চ্যানেল বন্যার পানিতে ডুবে গেলে বা মেক্সিকো উপসাগরের একাধিক তেল পরিশোধনাগার কয়েক সপ্তাহ বা মাসের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে তেলের দাম আবার হু হু করে বাড়তে পারে। আর এ ধরনের বিপর্যয় হলে যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ঝড় বয়ে যেতে পারে। কারণ, মানুষ যা উৎপাদন ও পরিবহন করে, তার সবকিছুর মূল বিষয় হচ্ছে জ্বালানি, তা সে শস্য হোক বা সরবরাহ হোক।

জ্বালানির ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন লেখক ড্যানিয়েল ইয়েরগিন। তাঁর ভাষ্য হচ্ছে, ‘তেলের দাম সব সময় মানুষকে বিস্মিত করার সক্ষমতা রাখে।’

তবে তেলের দাম আরও কিছুটা কমতে পারে। বিষয়টি হচ্ছে, ইরান যদি ইসলামিক রিপাবলিক গার্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি থেকে সরে আসে এবং নতুন পরমাণু চুক্তির খসড়ায় সম্মত হয়, তাহলে বাজারে দৈনিক আরও ১০ লাখ ব্যারেল তেল আসতে পারে।

ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে দেশে নীতি সুদহার বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এতে বিনিয়োগকারী ও অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, মন্দা আসন্ন। অর্থাৎ চাহিদা কমে যাবে, যদিও বেকারত্বের হার এখনো বেশি নয়, মুনাফার হারও ভালো।

বাজার বিশ্লেষণকারী কোম্পানি ইএসএআই এনার্জির প্রেসিডেন্ট সারাহ্ এমারসন বলেন, ‘আমি মনে করি, তেলের দাম আরও কমতে পারে। বেশ কিছু বিষয় একসঙ্গে ঘটছে, তৃতীয় প্রান্তিকে চীন অপরিশোধিত তেল আমদানি হ্রাস করছে, গ্যাসোলিনের মৌসুম শেষ হচ্ছে; অর্থনৈতিক শ্লথগতি নিয়ে উদ্বেগ আছে, যদিও সরবরাহ যথেষ্ট।’

সারাহ্ এমারসন আরও বলেন, ‘তার মানে এই নয় যে তেলের দাম আবার বাড়বে না। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক রিজার্ভ থেকে তেল উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমন্বিতভাবে যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে দিনে মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করেছে। এবার শীত বেশি পড়লে ইউরোপের মানুষ গ্যাসের বদলে তেল পোড়াতে পারে, এমন সম্ভাবনা আছে।’

পাড়ার ফিলিং স্টেশনে তেলের দাম দৈনিক ওঠানামা করে। অর্থনীতিবিষয়ক ধারণায় তেলের দামের বড় ভূমিকা আছে। রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বালানির অর্থনীতিবিদ মার্ক ফিনলে বলেন, ‘জ্বালানির দাম বড় বিষয় নয়; কিন্তু ভোক্তার আত্মবিশ্বাসে এর প্রভাব বিবেচনা করা হলে বিষয়টি পৃথিবীবিষয়ক মানুষের ধারণার সমতুল্য।’

আরবিসি ক্যাপিটাল মার্কেটসের জুন মাসের প্রতিবেদন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের ব্যক্তিগত ব্যয়ের ৩ দশমিক ৫ শতাংশ গ্যাসোলিনের পেছনে যায়। নিম্ন আয়ের মানুষ বা গ্রামাঞ্চলের কর্মী, যাঁদের গাড়ি পুরোনো হয়ে গেছে বা যাঁদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়, গ্যাসোলিনের মূল্যবৃদ্ধিতে বিশেষ করে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

তবে সামগ্রিকভাবে তেলের দাম এখন আর আগের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষ এখন আগের চেয়ে উন্নতমানের বা জ্বালানিসাশ্রয়ী গাড়ি চালাচ্ছেন এবং ইদানীং আরও অনেক মানুষ ঘর থেকে কাজ করছেন। কিন্তু গ্যাসোলিন ও ডিজেলের পেছনে যত বেশি ব্যয় হবে, মানুষের অন্যান্য ব্যয় তত কমবে।

জ্বালানির দাম বড় বিষয় নয়; কিন্তু ভোক্তার আত্মবিশ্বাসে এর প্রভাব বিবেচনা করা হলে বিষয়টি পৃথিবীবিষয়ক মানুষের ধারণার সমতুল্য
রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বালানির অর্থনীতিবিদ মার্ক ফিনলে

তেলের দাম কমলে বিভিন্ন শিল্প ও কৃষি খাতের ব্যয়ও কমে, যেমন তার মধ্যে আছে রাসায়নিক ও সার। জাহাজ পরিবহন ব্যয় তখন কমে আসে। কিন্তু তেলের দাম বাড়লে অন্যান্য সবকিছুর দাম বাড়ে এবং অর্থনীতি চাপের মুখে পড়ে, ১৯৭০ ও ২০০৮ সালে যা ঘটেছিল। কখনো কখনো এর রাজনৈতিক পরিণতিও দেখা যায়।

বিভিন্ন ধরনের শর্তের ওপর তেলের দাম নির্ভর করে, তাই তেলের দাম নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা বোকার কাজ। একদিকে ভেনেজুয়েলা, নাইজেরিয়া ও লিবিয়ার মতো বিক্রেতা দেশ আছে, অন্যদিকে সরকারি–বেসরকারি বিনিয়োগ কোম্পানির নির্বাহীদের সিদ্ধান্ত দ্বারাও তা প্রভাবিত হয়।

সিটি গ্রুপের পণ্যবিষয়ক এক প্রতিবেদনে নানা ধরনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আকাশে যখন মন্দার ঘনঘটা, তখন প্রকৃত অর্থে কী ঘটতে যাচ্ছে। নাকি একটি হারিকেন (ঝড়) হবে, তেলের দাম আবার ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করবে? নাকি মন্দা হবে আর তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলারের নিচে নেমে যাবে? আর তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলারের নিচে নেমে গেলে গ্যাসোলিনের দাম প্রতি গ্যালন আরও ১ ডলার কমে যেতে পারে।

জ্বালানিবাজার আবার মিশ্র সংকেত দিচ্ছে। গত সপ্তাহের পূর্বাভাসে অর্গানাইজেশন অব দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিস বলেছে, চলতি ও আগামী বছর তেলের চাহিদা বাড়বে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এরা আশা করছে, ২০২৩ সালে দৈনিক চাহিদা ১০৩ মিলিয়ন ব্যারেল বাড়তে পারে।

সিটি গ্রুপের এই পূর্বাভাসের পর গোল্ডম্যান স্যাকস আরেক পূর্বাভাসে বলেছে, চাহিদা বাড়ার কারণে তেলের দাম আবার বাড়তে পারে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই হলে বেকারত্ব হ্রাস পাবে, পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা স্থিতিশীল হবে।

তবে বিশ্ববাজারে তেল সরবরাহে রাশিয়ার ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। প্রতি ১০ ব্যারেল তেলের মধ্যে রাশিয়া জোগান দেয় ১ ব্যারেল। বিশ্ববাজারে দৈনিক তেলের চাহিদা ১০ কোটি ব্যারেল। ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার জোগান কমেছে দৈনিক ৫ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে ইউরোপ রাশিয়াকে আরও চাপে ফেলবে, তখন রাশিয়ার সরবরাহ আরও ৬ লাখ ব্যারেল কমতে পারে।

এর জবাবে রাশিয়া গ্যাস রপ্তানি আরও কমিয়ে দিলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়াতে পারে যে ইউরোপের মানুষ শীতকালে ঘর গরম করতে গ্যাসের বদলে তেল ব্যবহার করবে।

জ্বালানিবাজার আবার মিশ্র সংকেত দিচ্ছে। গত সপ্তাহের পূর্বাভাসে অর্গানাইজেশন অব দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিস বলেছে, চলতি ও আগামী বছর তেলের চাহিদা বাড়বে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এরা আশা করছে, ২০২৩ সালে দৈনিক চাহিদা ১০৩ মিলিয়ন ব্যারেল বাড়তে পারে।

ব্রাজিল, গায়ানা, যুক্তরাষ্ট্রে তেলের উত্তোলন বেড়ে যাওয়ার কারণে বাজারে তেল সরবরাহ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। সৌদি আরবসহ পারস্য উপসাগরীয় অন্যান্য দেশও একই পথে হাঁটছে। যদিও বাইডেন প্রশাসন যেভাবে চাচ্ছে, ঠিক সেভাবে নয়। ওপেক ও তার অংশীদারেরা, যেমন রাশিয়া জুলাই-আগস্ট মাসে দৈনিক তেল উৎপাদন ৬ লাখ ব্যারেল পর্যন্ত বৃদ্ধির অঙ্গীকার করেছে, যদিও তারা কোনোভাবে সে পর্যন্ত যেতে পারেনি।

এদিকে ইউরোপ ও আমেরিকার জ্বালানি পরিশোধনের সক্ষমতা কমলেও মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার বেড়েছে। এতে গ্যাসোলিনসহ অন্যান্য জ্বালানির দাম কমতে পারে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে চাহিদা কমে যাওয়া, অথচ বিশ্বের সামগ্রিক গ্যাসোলিন চাহিদার এক-তৃতীয়াংশই সেখানে। গ্রীষ্মকালে মানুষের যাতায়াত বেড়ে যায়। ফলে মেমোরিয়াল ডে থেকে লেবার ডে পর্যন্ত তেলের চাহিদা দিনে চার লাখ ব্যারেল পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু জে পি মরগানের পণ্য গবেষণা বিভাগের তথ্যানুসারে, এ বছর গ্যাসোলিনের চাহিদা গড়পড়তা।

তবে মূল্য হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা বদলে যেতে পারে। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসোলিনের চাহিদা দিনে ৫ লাখ ৮ হাজার ব্যারেল পর্যন্ত বেড়েছে। তা সত্ত্বেও গত বছরের এ সময়ের তুলনায় গ্যাসোলিনের চাহিদা এখনো দিনে ৩ লাখ ব্যারেল কম।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ। মানুষ ক্রমেই জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে জ্বালানি খাতের বিনিয়োগকারীরা তেলভিত্তিক পরিবহনের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। তাঁদের ভাষ্য, দীর্ঘ মেয়াদে জীবাশ্ম জ্বালানির দাম কমবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগবিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল স্পার্লিং বলেন, ‘বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে, এটা
বড় ইঙ্গিত।’

ক্লিফোর্ড ক্রাউস: নিউইয়র্ক টাইমস–এর জ্বালানি প্রতিনিধি

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন