বাবার প্রসঙ্গ উঠলে তাঁর একটা কথা গর্ব করে বলি, তিনি আমাদের ভুল করার অধিকারসহ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। ভুল করার সুযোগ না থাকলে স্বাধীনতার পূর্ণতা আসে না। ইংরেজ কবি আলেক্সান্ডার পোপের কবিতার যে পঙ্ক্তিটি প্রবাদে পরিণত হয়েছে, তা কারও অজানা নয় ‘টু আর ইজ হিউম্যান; টু ফরগিভ, ডিভাইন’। বাংলা করে বলা যায়, মানুষ মাত্রই ভুল করে; ক্ষমা হলো স্বর্গীয় (বা ঐশ্বরিক)।
ওপরের কথাগুলো যে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে একটি পোস্টের ছবি ও উদ্ধৃতির অসংগতিকে ঘিরে দুই দিন ধরে যেসব ঘটনা ঘটেছে সে প্রসঙ্গেই তোলা হলো, আশা করি তা পাঠক বুঝতে পারছেন। ঘটনাটি ভুল না অপরাধ, সে বিষয়ে সংশয়ের তেমন অবকাশ আছে বলে মনে হয় না; কারণ, অন্য কেউ দোষ ধরার আগেই ত্রুটিটি নজরে আসায় তারাই তা প্রত্যাহার করে নেয়, ভুল স্বীকার করে, দুঃখও প্রকাশ করে।
এরপরও পুরো ঘটনাকে অপরাধের পর্যায়ে গণ্য করতে গেলে পরবর্তী কার্যক্রম জবরদস্তিমূলক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ ক্ষেত্রে তা-ই ঘটছে বলে মনে হচ্ছে।
প্রথম আলো দেশের সবচেয়ে বড় পত্রিকা। নিজের জোরেই পত্রিকাটি নিজস্ব পথে চলতে চায়, যা চরম বিপরীত দুটি ভাগে বিভক্ত সমাজে তাকে একা করে রেখেছে। এ বাস্তবতায় প্রথম আলোর ওপর অসন্তুষ্ট আছেন অনেকেই এবং তার ন্যায্য ভিত্তিও থাকতে পারে।
কিন্তু সেই আবেগের বশবর্তী হয়েও ভুলকে অপরাধ বলার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা কঠিন; বরং দেখা যাচ্ছে বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম আলোর সমব্যথীর সংখ্যা বাড়ছে, এবং অনেকের বিবেচনায় উল্টো দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আমরা পাকিস্তান আমলে ‘স্বাধীনতার ভিত্তিমূলে আঘাত’ বা ‘ইসলাম বিপন্ন’ এমন সব অভিযোগে বিদ্ধ হতাম।
তাতে শেষ বিচারে পাকিস্তানই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বাংলাদেশে স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পর যখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনার সরকার বিপুল সাফল্যে পূর্ণশক্তিতে দেশ পরিচালনা করছে, তখন এ ধরনের কথা নিজেদেরই দুর্বলতা প্রকাশ করে। এমন মনোভাব কাম্য নয়।
শেষ কথা হলো, যে সমাজে ভুল করার সুযোগ থাকে না, সেখানে নতুন চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটবে না। মানবজীবন ও মানবসৃষ্ট—সবকিছুতেই ভুল সংশোধনের সুযোগ রাখতে হয়, সেটা সংবিধান থেকে ফ্লাইওভারের নকশা পর্যন্ত সবটাতেই লাগে। আর যদি ক্ষমার প্রাসঙ্গিকতা উপেক্ষিত হয়, তবে সমাজ থেকে মহত্ত্বের সাধনা হবে নির্বাসিত। তেমন সমাজ যুগপৎ চিন্তা ও চিত্তের দৈন্যে ভুগবে।
আমরা বলব ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে। যে আইন নিরাপত্তামূলক, তা মানুষের জন্য বর্ম হওয়ার কথা, শক্তিমানের হাতিয়ার নয়। প্রণয়নের পর্যায়েও এই আইনের সংশোধন, পরিমার্জন হয়েছে; এর পরাক্রম নিয়ন্ত্রণে আরও সংশোধনের কথা ভাবা দরকার।
আবুল মোমেন: লেখক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক