জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর আদায় করে নেওয়ার ভয়ে নোয়াখালীতে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নারী প্রধান শিক্ষক বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিরাপত্তাহীন ওই প্রধান শিক্ষকের নাম ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মানিকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
ফরিদা ইয়াসমিন একই সঙ্গে বসুরহাট পৌর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই তাঁর পদত্যাগের দাবি করছে একটি মহল। তবে ফরিদার দাবি, তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় নন। আওয়ামী লীগ নেতা কাদের মির্জা তাঁকে এই পদ নিতে বাধ্য করেছেন। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি তাতে সায় দিয়েছেন কেবল।
ফরিদা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে জানান, গত ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের কিছু নেতা-কর্মী তাঁকে পদত্যাগ করার জন্য নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর বাড়িতে হামলার চেষ্টাও হয়েছিল। প্রধান শিক্ষক বিষয়টি টের পেয়ে এক কাপড়ে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন।
ফরিদা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষকতা তাঁর পেশা ও নেশা। ২০০০ সাল থেকে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে তিনি এই পেশায় যুক্ত। আগে দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন শেষে ২০২০ সালে প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে মানিকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হন। তাঁর সঙ্গে ছয়জন প্রার্থী ওই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি প্রথম হয়েই প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন।
ফরিদা ইয়াসমিন জানান, শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণেই তাঁকে একদিন ডেকে পাঠান বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। তাঁকে কাদের মির্জা বসুরহাট পৌর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার জন্য চাপ দেন। তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি মির্জার কথার বাইরে যেতে পারেননি। কিন্তু তিনি কখনোই শিক্ষকতা ও রাজনীতিকে এক করেননি। বরাবরই চেষ্টা ছিল বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উন্নতির।
ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ৬ আগস্ট বিদ্যালয় থেকে ছুটি নেন। এরই মধ্যে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের একদল নেতা-কর্মী তাঁর পদত্যাগের দাবি তোলেন এবং বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। কয়েক দিনের মধ্যে বন্যা দেখা দিলে বিদ্যালয়ও বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলে ৮ সেপ্টেম্বর থেকে বিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী বিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি ছিল তাঁর। কিন্তু ৭ সেপ্টেম্বর রাতে তিনি জানতে পারেন, পরদিন স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের একদল নেতা-কর্মী তাঁর পদত্যাগের দাবিতে বিদ্যালয়ে তালা দেবেন। তখন তিনি আর বিদ্যালয়ে যাননি।
প্রধান শিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিন অভিযোগ করেন, গত ১১ সেপ্টেম্বর একই ব্যক্তিরা বিদ্যালয়ে ঢুকে শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক শ্রেণিকক্ষ থেকে বের করে পিকআপ ও মোটরসাইকেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে নিয়ে গিয়েও তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ দিতে বাধ্য করেন। সেখান থেকে ফেরার পথে বেলা একটার দিকে তাঁরা পরিকল্পনা করেন তাঁর বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাঁর কাছ থেকে জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর আদায় করে নেবেন। তিনি বিষয়টি জানতে পেরে তাৎক্ষণিক এক কাপড়ে কলেজপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে বাড়ির পেছন দিয়ে পালিয়ে যান। পরে জানতে পারেন বিএনপি ও জামায়াতের একদল লোক তাঁর বাড়ির সামনে পর্যন্ত এসে যখন জানতে পারেন তিনি বাড়িতে নেই, তখন তাঁরা ফিরে যান।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব মাহমুদুর রহমান রিপন প্রথম আলোকে বলেন, অনিয়ম করে কাদের মির্জা ফরিদা ইয়াসমিনকে নিয়োগ দিয়েছেন। যিনি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন, তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও এলাকার মুরব্বিরা সবাই তাঁর বিপক্ষে। তাঁরা ফরিদা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। তবে ওই ঘটনার সঙ্গে বিএনপির কেউ জড়িত কি না, তাঁর জানা নেই। একই রকম তথ্য দিয়েছেন কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভা জামায়াতের আমির মোশারফ হোসেনও। তিনি বলেন, নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে এলাকার লোকজন ওই প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ দাবি করেছেন। এর সঙ্গে জামায়াতের কেউ জড়িত নেই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার হোসাইন পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, মানিকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছুটিতে রয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একাধিক বৈঠক করেছেন। বৈঠকে আলোচনা শেষে, যেহেতু প্রধান শিক্ষক অনুপস্থিত, সেহেতু প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সহকারী প্রধান শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।