ফুটপাত থেকে সড়ক—সবখানে বাধা, নেই ডিজিটাল সাদাছড়ির সুফল

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন ভিজ্যুয়ালি ইম্পেয়ার্ড পিপলস সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম
ছবি: জাহিদুল করিম

সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা চার লাখের বেশি। এসব মানুষের স্বাধীন ও নিরাপদে পথ চলতে সহায়তা করছে সাদাছড়ি। তবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, লজ্জা ও সংকোচে এর ব্যবহার সীমিত।

এদিকে কয়েক বছর ধরে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও সংগঠনকে ভারত থেকে আনা ডিজিটাল সাদাছড়ি বিনা মূল্যে দিচ্ছে। তবে ফুটপাতসহ চারপাশে চলাচলের পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় এ ছড়ি ব্যবহারের সুফল পাচ্ছেন না দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। এমন বাস্তবতায় ১৫ অক্টোবর দেশে পালিত হবে বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিরাপদে চলাচলের প্রতীক হিসেবে সাদাছড়ি ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয় মূলত ১৯৩০ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৬৪ সালে মার্কিন কংগ্রেসে একটি আইন পাসের মাধ্যমে সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করছে সরকার ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন। এ বছর বাংলাদেশে দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘দৃষ্টিজয়ে ব্যবহার করি, প্রযুক্তিনির্ভর সাদাছড়ি’।

নেই চলাচলের উপযুক্ত পরিবেশ

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা নূর নাহার তনিমা। তিনি বৃত্তি পেয়ে কম খরচে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতকে পড়ছেন। তাঁর স্বামীও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। নূর নাহার জানালেন, তিনি সাদাছড়ি ছাড়া ঘরের বাইরে বের হন না। সাদাছড়ি ব্যবহার করে বাজার করা, বাসে যাতায়াতসহ সব কাজই একা করেন। তবে তিনি দেশে বানানো ২০০ টাকা দামের সাধারণ সাদাছড়ি ব্যবহার করেন। ডিজিটাল সাদাছড়ি ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে পারেননি।

নূর নাহার বললেন, সামনে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে ডিজিটাল সাদাছড়ি কাঁপতে থাকে বা সংকেত দিতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটপাতে গাছ, দোকান, গর্ত থেকে শুরু করে সবই আছে। টেকটাইল বা প্রতিবন্ধীবান্ধব ফুটপাত তৈরির উদ্যোগও সীমিত। ফলে ডিজিটাল সাদাছড়ি কী দেখে যে সংকেত দেয়, সেটা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন ভিজ্যুয়ালি ইম্পেয়ার্ড পিপলস সোসাইটির (ভিপস) সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম দীর্ঘদিন ধরে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাদাছড়ি ব্যবহারসহ নিরাপদে পথচলার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তিনি বলেন, সামনে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে ডিজিটাল সাদাছড়ি চার মিটার দূর থেকেই সংকেত দিতে শুরু করে। কিন্তু আমাদের দেশে যানবাহনের হর্নের শব্দসহ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনায় এ ছড়ির সংকেতগুলো অনুসরণ করতে পারছেন না প্রতিবন্ধী মানুষেরা। সম্প্রতি কুমিল্লায় একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি খোলা ম্যানহোলে পড়ে মারা গেছেন। সাদাছড়ি তো বলতে পারছে না ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা। তাই ডিজিটাল সাদাছড়ির পাশাপাশি চলাচলের পরিবেশেও পরিবর্তন আনতে হবে।

ভিপসের ক্যাপাসিটি বিল্ডিং কর্মকর্তা এসহাক শাহীন ভূঁঞা ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে সব ইমারত, স্থাপনা যাতে প্রতিবন্ধীবান্ধব হয়, সেই আহ্বান জানালেন। উদাহরণ হিসেবে রাজধানীর আদাবরে তাঁর অফিস ভবনের লিফটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, লিফটে কোনো ব্রেইল ডিজিট ব্যবহার করা হয়নি। অডিও বা শব্দ করে বলে দেওয়া হচ্ছে না দরজা বন্ধ হচ্ছে বা খোলা হচ্ছে কিংবা কত তলায় থেমেছে। ফলে হাতে ডিজিটাল সাদাছড়ি থাকলেও একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির পক্ষে লিফটে একা চলাচল করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

সাদাছড়ি নিয়ে একা একা সব কাজ করেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নূর নাহার তমা

দেশে উদ্ভাবন, দাম নিয়ে উদ্বেগ

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বাস্তবায়নাধীন ও ইউএনডিপির সহায়তায় পরিচালিত (এটুআই) প্রকল্পের পক্ষ থেকে দেশেই উন্নত মানের ডিজিটাল সাদাছড়ি উদ্ভাবিত হয়েছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহারের উপযোগী কি না, সেই পরীক্ষা হয়েছে। এখন এ ছড়ি উৎপাদন শুরুর প্রক্রিয়া চলছে। এরপর বাজারজাত করা হবে। এটি উদ্ভাবন এবং এ পর্যায়ে আসতে প্রায় চার বছর লেগেছে। তবে এ ডিজিটাল ছড়ির একেকটির দাম পড়বে সাত হাজার টাকা। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বলছেন, এ দাম তাঁদের নাগালের বাইরে।

এটুআই প্রকল্পের আহসান হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর উদ্ভাবিত ডিজিটাল সাদাছড়িতে বেশ কিছু বাড়তি সাংকেতিক চিহ্ন রয়েছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পা থেকে মাথা বরাবর যে প্রতিবন্ধকতা থাকবে, তা বলে দেবে ডিজিটাল সাদাছড়ি। যে গর্ত থাকবে, তার গভীরতা বেশি না কম—সেটাও জানা যাবে। হিউম্যান ডিটেক্টর বোতাম চালু করলে নিরাপত্তার বিষয়টিতেও সংকেত পাওয়া যাবে। জায়গাটি অন্ধকার হলে ছড়িতে আলো জ্বলবে, যাতে অন্যরা ওই ব্যক্তিকে দেখতে পারেন। ছড়ি রেখে কোথাও গেলে এ সময়ে যদি অন্য কেউ এ ছড়িতে হাত দেয়, সেই সংকেতও দেবে।

আহসান হাবীবের মতে, ডিজিটাল সাদাছড়ি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বুঝতে হবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যখন এটা বুঝতে পারবেন, তখনই এর ব্যবহার বাড়বে। ব্যবহারে সমস্যা হলে সে অনুযায়ী সংকেতে পরিবর্তন আনা সম্ভব বলেও জানান তিনি।

ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের পরিচালক প্রভাষ চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ভারত থেকে আনা ডিজিটাল সাদাছড়ি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এটি ব্যবহার করতে গিয়ে কী সমস্যা হচ্ছে, তা নিয়ে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকেও কিছু অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে যেকোনো নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের শুরুতে কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকে। সেসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে আলোচনা ও গবেষণা প্রয়োজন।

সাদাছড়ি, বিশেষ করে ডিজিটাল সাদাছড়ির ব্যবহার বাড়াতে বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন ভিপসের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম। তাঁর মতে, ডিজিটাল সাদাছড়ির পাশাপাশি দেশে টেকসই ও উন্নত মানের প্রচলিত সাদাছড়ি তৈরি করতে হবে। আগ্রহী উদ্যোক্তাদের বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে উৎসাহ দিতে হবে। সাদাছড়ির দামের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।

সাদাছড়ি ব্যবহারের কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও প্রচার বাড়ানো, গ্রাম ও শহরে অবকাঠামো, রাস্তা ও ফুটপাত নির্মাণের ক্ষেত্রে সর্বজনীন নির্মাণবিধি নকশা ও পরিকল্পনা অনুসরণ, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য চলাচলে সহায়ক দিকনির্দেশনামূলক সফটওয়্যার তৈরির উদ্যোগ নেওয়ারও পরামর্শ জাহাঙ্গীর আলমের।

‘সাদাছড়ি আমাদের চোখ’

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নূর নাহারের মতে, সাদাছড়ি ব্যবহারের কোনো অপকারিতা নেই। তাঁর কথা, ‘আমরা যাঁরা চোখে দেখতে পাই না, সাদাছড়ি তাঁদের চোখ। এই ছড়ি হাতে নিয়ে আমি যদি নিজের কাজ নিজে স্বাধীনভাবে করতে পারি, তখনই আমাকে স্মার্ট লাগবে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।’

নূর নাহার আরও বলেন, ‘আমার মা–বাবাও একসময় আমাকে নিয়ে ভয়ে থাকতেন। বাইরে বের হয়ে পড়াশোনা করব, তা চাননি তাঁরা। এখনো অনেক বাধা আসে। ২০১৬ সালে যখন রাস্তায় সাদাছড়ি নিয়ে বের হতাম, তখন আশপাশের লোক একা কেন বের হয়েছি, তা নিয়ে বিরক্ত হতেন বা ভয় পেতেন। আর এখন বের হলে আশপাশের অনেকে যখন বলেন, “এই মেয়েটা একাই চলাফেরা করতে পারে”—তখন বেশ ভালো লাগে। আত্মবিশ্বাস বাড়ে।’

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জাকির হোসেনের বয়স ৮০ পার হয়েছে। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম ১৯৮৯ সালে সাদাছড়ি বানানো শুরু করেছিলেন। রাজধানীর মিরপুরে পুরোনো আমলের তিনতলা একটি বাড়িতে ‘জাকির হোয়াইট ক্যান ওয়ার্কস’ নামের কারখানায় এখন বাবার দেখানো পথে সাদাছড়ি তৈরি করছেন ছেলে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করা মো. ইয়াসিন। দেশে ডিজিটাল সাদাছড়ি আসার পর থেকে সরকার তাঁর কাছ থেকে ২০০ টাকা দামের সাদাছড়ি কিনছে না। কিনছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা।

ইয়াসিনের ক্ষোভ, সরকার এখন পর্যন্ত সাদাছড়ি তৈরি ও ব্যবহারে তাঁর বাবার যে অবদান, সেটির স্বীকৃতি দেয়নি। তাঁর চাওয়া, বেঁচে থাকতে থাকতেই যেন তাঁর বাবা এই স্বীকৃতি পান।