মেইল ও কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ লাভজনক প্রতিষ্ঠান, তবে...

২০১৩ সালে মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ যাত্রা শুরু করে। কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের জন্য তখন একটি বিধিও প্রণীত হয়
ছবি: ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

এক যুগ আগে দেশে কুরিয়ার সার্ভিসের প্রসার ঘটলে সরকার সেখানে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের চিন্তা শুরু করে। কর্তৃপক্ষ ১০ বছর আগে গঠিত হলেও আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হতেই কেটে গেছে ৯ বছর। ব্যয়ের খাত তেমন না থাকায় প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক এবং সরকারকে তারা এখন পর্যন্ত ১১ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারে শৃঙ্খলা আনতে এ কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করতে হবে এবং কাজের পরিধি বাড়াতে হবে।

দ্য পোস্ট অফিস অ্যাক্ট ১৮৯৮–এর ধারা ৪ ও ৮ সংশোধন করে ২০১৩ সালে মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ যাত্রা শুরু করে। কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের জন্য তখন একটি বিধিও প্রণীত হয়।

লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের বয়স ১০ বছর। কিন্তু তারা কাজ শুরু করতে পেরেছে বছরখানেক আগে থেকে। এর আগে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন নিবন্ধন ও নবায়নের বিষয়গুলো দেখতেন।

লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ২০০টিকে শনাক্ত করেছেন, যাদের নিবন্ধন নেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত লাইসেন্সপ্রাপ্ত অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হচ্ছে ১০৪, আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ৮৯ এবং অন-বোর্ড প্রতিষ্ঠান ৩০টি। নিবন্ধন বাতিল হয়েছে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের।

সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীন এই সেবাধর্মী সরকারি প্রতিষ্ঠান গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে রাজধানীর জিপিওতে পুরোনো ডাক ভবনের তৃতীয় তলায় নিজেদের কার্যালয়ের উদ্বোধন করে। পূর্ণ দায়িত্বের একজন চেয়ারম্যান প্রথমবারের মতো যোগ দেন গত বছরের জানুয়ারিতে। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শনের জন্য মাত্র দুজন পরিদর্শক আছেন। সব মিলিয়ে ছয়জনের জনবল নিয়েই কর্তৃপক্ষ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের নিয়োগ বিধিমালার খসড়া হয়েছে। চূড়ান্ত হলে তারা জনবল নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করবে। এ ছাড়া তাদের আইনের খসড়াও হয়েছে।

এ কর্তৃপক্ষের মূল কাজ হচ্ছে লাইসেন্স ও এজেন্সির অনুমতি প্রদান। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান নির্ধারণ ও তা পরিবীক্ষণ, নির্দেশিকা প্রণয়ন, গ্রাহক ও এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সালিসকারীর ভূমিকা পালন এবং শর্ত ভঙ্গ করলে ব্যবস্থা নেওয়ার কাজগুলো করে এ কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া সেরা প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার প্রদান এবং ডাকসেবা উন্নয়নে গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়াও তাদের দায়িত্ব।

ডেলিভারি টাইগারের সিইও ফাহিম মাশরুর বলেন, এ ধরনের কর্তৃপক্ষ থাকা জরুরি। কারণ, এটা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা। এখানে আর্থিক বিষয় জড়িত। দেশের অনেক বড় বড় কুরিয়ার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানসহ অনেকেই এখনো নিবন্ধন নেয়নি। তাদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

দেশে কী পরিমাণে মেইল অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান আছে, তার সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায় না। তবে কুরিয়ার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমিতি কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিএসএবি) বলছে, সংখ্যাটা পাঁচ শতাধিক। লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ২০০টিকে শনাক্ত করেছেন, যাদের নিবন্ধন নেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত লাইসেন্সপ্রাপ্ত অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০৪, আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ৮৯ এবং অন-বোর্ড প্রতিষ্ঠান ৩০টি। নিবন্ধন বাতিল হয়েছে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের।

কাজ পুরোদমে শুরু করতে না পারলেও এই লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ লাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান। প্রথম তিন বছর তাদের কোনো ব্যয় না থাকায় আয়ের পুরোটাই ছিল লাভ। তাদের আয়ের পরিমাণ প্রতিবছর বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের গত মার্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির আয় ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ৮৮ হাজার ৪৯০ টাকা। সরকারকে ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তারা ১১ কোটি ২০ লাখ টাকা রাজস্ব জমা দিয়েছে।

এ ছাড়া গত অর্থবছরে তাদের আয় ছিল ১ কোটি ৬৮ লাখ ৩৫ হাজার ৭৩৫ টাকা, যার মধ্যে ৯৬ লাখ টাকাই ছিল ক্ষতিপূরণ ফি। তাদের বাকি আয় আসে নিবন্ধন ফি ও নবায়ন ফি থেকে। নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটি বুকিং থেকে সরকার–নির্ধারিত নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষকে দিতে হয়। এটাকেই ক্ষতিপূরণ ফি বলা হয়। কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জানান, নতুন আইনে তারা ‘ক্ষতিপূরণ’ শব্দের পরিবর্তে অন্য কিছু যুক্ত করার কথা ভাবছেন।

এই ক্ষতিপূরণ ফি নিয়ে আপত্তি আছে কুরিয়ার সমিতি সিএসএবির। সংগঠনটির সভাপতি এবং সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স দেওয়া হয়। নিবন্ধন ফি, নবায়ন ফি দেওয়া হয়। এরপরও এই ফি কেন দিতে হবে, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি। এ ছাড়া ‘মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন ২০২২’–এর খসড়ার শাস্তি ও জরিমানা বিষয়েও সমিতির আপত্তি আছে বলে জানান। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অভ্যন্তরীণ কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ও নবায়ন ফি বেশি। এটাও সংশোধনের দাবি এই সমিতির।

সিএসএবির সভাপতি হাফিজুর রহমান বলেন, কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়াতে হবে এবং নিবন্ধন ছাড়া যারা ব্যবসা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কুরিয়ার সার্ভিসসংক্রান্ত কোনো অভিযোগ থাকলে সেটার নিষ্পত্তিও করবে এই কর্তৃপক্ষ। তবে এখন পর্যন্ত তাদের কাছে কোনো অভিযোগ জমা পড়েনি। অভিযোগ এখন সরাসরি তাদের কার্যালয়ে গিয়ে দিতে হবে। তবে আগামী দুই মাসের মধ্যেই অনলাইনে তা করা যাবে।

মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, কুরিয়ার সেবার চাহিদা এখন অনেক বেড়েছে। এই সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোরও জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার প্রয়োজন আছে। সে বিষয়গুলোই দেখভাল করবেন তাঁরা।

লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের কাজের পরিধি আরও বাড়ানোর কথা উল্লেখ করে ডেলিভারি টাইগারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কর্তৃপক্ষ থাকা জরুরি। কারণ, এটা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা। এখানে আর্থিক বিষয় জড়িত। দেশের বড় বড় কুরিয়ার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানসহ অনেকেই এখনো নিবন্ধন নেয়নি। তাদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

নিবন্ধন নিতে গেলে বড় অঙ্কের জামানত দিতে হয় জানিয়ে ফাহিম মাশরুর বলেন, টাকার পরিমাণ অনেক বেশি হলেও এটা দরকার আছে। ইভ্যালির উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ইভ্যালির যদি এই নিবন্ধন ও জামানত থাকত, তাহলে সরকার সেখান থেকে গ্রাহককে টাকা দিতে পারত।