চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে শিবচতুর্দশী মেলা শুরু হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। এ উপলক্ষে উপজেলার রাস্তাঘাটে এখন পুণ্যার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। গতকাল রাত নয়টার কথা। পৌর সদরের মহন্ত আস্তান বাড়িতে ধর্মসভা সবে শেষ হয়েছে। ভক্তরা সভাস্থল ত্যাগ করছিলেন তখন। বাড়ির মূল ফটকের কাছেই আমবাগান। সেখান থেকে ভেসে আসছিল গানের শব্দ। মিষ্টি সুরেলা গলার শিল্পীকে ঘিরে রয়েছেন পুণ্যার্থীরা। কাছে গিয়ে দেখা গেল বছর দশেকের একটা মেয়ে গাইছিল বাউল শাহ আবদুল করিমের গান ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নাও’। তার সঙ্গে ঢোল বাজাচ্ছিল তার চেয়ে কম বয়সী এক বালক।
ঢোল আর বাদ্যযন্ত্রের তালে গানের সুরে অন্য এক আবহ তৈরি হলো চারদিকে। গান শুনতে শুনতে পুণ্যার্থীরা পকেট থেকে টাকা বের করে দিচ্ছিলেন তাদের। সেসব কুড়িয়ে নিচ্ছিলেন পাশে থাকা আরেক ব্যক্তি।
গানের সুরে দর্শকমাতানো দুই শিশু ভাই-বোন। ১০ বছর বয়সী সুপ্রিয়া দেওয়ানের গানের সঙ্গে ঢোল-তবলা আর অর্গান বাজায় তার ভাই আট বছরের সুদর্শন দেওয়ান। বাবা কৃষ্ণ কমল বর্মণ ও মা রেখা দেওয়ানের সঙ্গে তারা ঢাকা থেকে সীতাকুণ্ড এসেছে গতকালই। উদ্দেশ্য তীর্থ দেখার পাশাপাশি গান গেয়ে কিছু আয়ও করা। দুই ভাই-বোন মা-বাবার সঙ্গে দিনের বেলায় ১ হাজার ২০০ ফুট ওপরে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠে চন্দ্রনাথ ধাম পরিক্রমা করেছে। দিনের বেলায় ধর্মীয় কাজ শেষ। রাতে তাই গান শুনিয়ে উপার্জনের আশায় ঘুরছে পরিবারটি।
চটপটে সুদর্শন দেওয়ানের সঙ্গে কথা হয় গানের এক ফাঁকে। সে জানাল, ছয় বছর বয়স থেকে সে ঢোল বাজাতে শুরু করে। বাবা–মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ঢোল বাজায়। এ ছাড়া সে খঞ্জনিও বাজাতে জানে। সে গুরুর কাছে গিয়ে এসব আয়ত্ত করেছে। গতকাল সকালে এসে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথধাম পরিক্রমা করেছে সে। তাই একটু ক্লান্ত লাগছিল তার।
সুদর্শনের বোন সুপ্রিয়া জানাল, সে অর্গান, হারমোনিয়াম, খঞ্জনি বাজাতে জানে। সে–ও ছয় বছর বয়স থেকে বাবা–মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে গান করে। দুই বছর আগে গুরুর কাছে গিয়ে সে–ও গানের প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এখন ঢাকার একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে।
তাদের বাবা কৃষ্ণ কমল বর্মণ প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছর আগে তাঁর ছেলে ও মেয়েকে ঢাকার মিরপুরের শিল্পী আক্কাস দেওয়ানের কাছে গান শিখতে দিয়েছেন। সেখানে তারা ১৭ মাস ছিলেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী আক্কাস দেওয়ানের কাছে গান শিখেছেন। তাই ছেলে-মেয়েদের নামের টাইটেল গুরুর নামের টাইটেল অনুসারে দেওয়ান লিখছেন। তাদের মায়ের নামের টাইটেলও দেওয়ান দিয়েছেন। মূলত তাদের নামের টাইটেল ছিল বর্মণ।
কৃষ্ণ কমল বলেন, তাঁর ছোট্ট ছেলেটি দীর্ঘ সময় ধরে ঢোল বাজাতে জানে। সে ঢোলে ভালোই তাল তুলতে পারে। ছেলে আর মেয়ের গলায় সুর আছে। এ জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি তারা গান করে। গান তাদের জীবনেরই অংশ।
কৃষ্ণ কমল বলেন, তিনি পেশায় একজন মাছ ব্যবসায়ী। ঢাকার ধানমন্ডি, জিগাতলা এলাকায় মাছের ব্যবসা করেন। থাকেন মিরপুর এলাকায়। কিন্তু তাঁদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। অবসরে গান করেন। সকালে মাছের ব্যবসা করেন। আর বিকেলে ছেলে মেয়েরা স্কুল থেকে আসার পর ঢাকার ফুটপাতে গান করেন। আবার অনেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য ভাড়া করে।
তিনি বলেন, সীতাকুণ্ডে তাঁরা তীর্থ করতে এসেছেন। অনেক দিনের আশা ছিল শিবচতুর্দশীতে চন্দ্রনাথ ধামে তীর্থ করবেন। অর্থের সংকুলান না থাকায় সুযোগ হচ্ছিল না। এবার তাঁরা তীর্থ করছেন। পাশাপাশি গান করে খরচটাও তুলছেন। একরকম রথ দেখা, কলা বেচার মতো।