রাজধানীর গুলিস্তানে ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের পাশে ‘এন্ড বিরিয়ানি হাউস’–এর আনোয়ার হোসেন কথা বলেন দার্শনিকের মতো করে। এক যুগ ধরে গুলিস্তানের বিভিন্ন খাবারের হোটেলে কাজ করায় অনেক অভিজ্ঞতা তাঁর। পথের ওপর সাজিয়ে রাখা খাবারের সবই খোলা কেন জানতে চাইলে ভাবলেশহীনভাবে তিনি উত্তর দিলেন, মানুষ দেখতে পছন্দ করে তাই। গুলিস্তানের মতো জনবহুল জায়গায় বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে কয়েকটি হোটেলে ঢুঁ দিয়ে দেখা গেল, সব জায়গার পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। মানুষ দেখতে পছন্দ করে বলে দোকানের সামনে নানা পদের উজ্জ্বল রঙের সব খাবারই খোলা।
এসব খাবারের কাছ দিয়ে প্রতি মুহূর্তে চলাচল করছেন পথচারী। দুই হাত দূরের সড়কে কালো ধোঁয়া ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাস ও মোটরসাইকেল। হাঁচি, কাশি ও শরীরের মৃত চামড়াসহ বাতাসে ভেসে যাওয়া কোনো কিছু থেকে নিস্তার নেই এসব খাবারের। ক্ষতি সম্পর্কে জানার পরেও পথের খাবার কেন খোলা থাকে, আর মানুষ কেন সেসব খাবারই খান তা জানতে প্রথম আলো কথা বলেছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, রাজধানীর বিভিন্ন খাবারের দোকানের বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সঙ্গে। উঠে এসেছে এগুলো দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষের নজরদারির ঘাটতি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের অসচেতনতা এবং হোটেলগুলোর সুযোগ নেওয়ার দৃশ্য।
ফুটপাতের মতো রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের রান্নাঘরের দৃশ্য, যা আমাদের সচরাচর দেখা হয় না। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের খাদ্যের বিশুদ্ধতা পরিবীক্ষণ ও বিচারিক বিভাগে যোগাযোগ করা হলে জনসংযোগ কর্মকর্তা আবুল হাসনাত প্রথম আলোকে বলেন, ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের রান্নাঘরে খাবার মজুতের জায়গায় তেলাপোকা পাওয়া গেছে। ফ্রিজে থাকা অনেক দিন আগের তিন থেকে চার কেজি মাছ নষ্ট করা হয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রান্নাঘরের সার্বিক পরিস্থিতি দেখে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেখানে খাদ্য প্রস্তুত ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের স্বাস্থ্য সনদ ছিল না। মেঝেতে যেখানে–সেখানে ময়লা ফেলে রাখা হয়। পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা ঠিক নেই।
১৬ ডিসেম্বর বিকেলে গুলিস্তানের ইষ্টিকুটুম রেস্তোরাঁয় বসে নাশতা করছিলেন কাপ্তানবাজার থেকে আসা বয়স্ক দুই নারী। সম্পর্কে তাঁরা বোন। খোলা খাবার থেকেই তাঁরা নিজেদের চাহিদা জানিয়েছিলেন—পরোটা ও সবজি। সেগুলোর সঙ্গে দেওয়া হয়েছে শসার সালাদ। খোলা খাবারগুলো শরীরের জন্য ক্ষতিকর জানার পরও কেন খাচ্ছেন জানতে চাইলে এক বোন বলেন, ‘রোজ তো খাচ্ছি না। এক দিন শখ করে খেতে এলাম।’ আর যাঁদের রোজ খেতে হয়, তাঁরাও বেছে নেন খোলা খাবার থেকেই। চোখের আড়ালে জালির নিচে ঢাকা খাবারটি বরং বাসি বলে তাঁদের মনে হয়। বিক্রেতারা তেমনটাই বলেছেন।
১৮ ডিসেম্বর দুপুরে গুলিস্তানে এসে থামছিল দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন বাস। যাত্রীরা নেমে কেউ কেউ জড়ো হচ্ছিলেন সেখানকার বিভিন্ন খাবারের হোটেলে। ছিলেন নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ। সওয়ারি টেনে কেউ বিরতি নিচ্ছেন, কেউ হয়তো ভ্রাম্যমাণ পণ্য বিক্রেতা। এন্ড বিরিয়ানি হাউসের আনোয়ার হোসেনের অনেক ধৈর্য। একই মাছের নাম কয়েকবার জানতে চাইলেও তিনি বিরক্ত হন না। তাঁর এই গুণের জন্যই এ দোকানে ভাত খেতে আসা মানুষের সংখ্যা বেশি। মোটরসাইকেল থামিয়ে খাবারের সামনে এসে পরখ করছিলেন মিরপুরের বাসিন্দা তারা মিয়া। তিনি দুই কামরার বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন মিরপুর ১ নম্বরে। এদিকে যাত্রী নিয়ে এসেছিলেন। দুপুর হয়ে গেছে, তাই খাওয়াটা জরুরি। তারা মিয়া পাল্টা প্রশ্ন করলেন—‘এসব জায়গায় কোনো দিন খাবার ঢাকা থাকে এ কথা কেউ বিশ্বাস করবেন? ঢাকাঢাকির চেয়ে ওনাদের ডাকাডাকি বেশি করতে হয়। বিক্রেতারা কখনো নিজেদের খাবারে জীবাণু দেখতে পান না। তবে জীবাণুর সঙ্গে পুষ্টিও তো কিছু শরীরে যায়’ বলে স্বগতোক্তি করলেন অপুষ্টিতে ভোগা মানুষটি। যেন লেখক শিবরাম চক্রবর্তীকে ধরতে গিয়ে পঞ্চানন কর্মকার তিনি।
শিবরাম চক্রবর্তী রাজনীতিও করতেন। তাঁকে ধরতে বারবার ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা পঞ্চানন কর্মকারকে। শিবরাম ছিলেন খাদ্যরসিক। যখন-তখন ঢুকে যেতেন খাবারের দোকানে। অনুসরণ করতে গিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তাকেও একই কাজ করতে হতো। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে তিনি ওজন বাড়িয়ে ঢোল। পরে সব শুনে শিবরাম চক্রবর্তী বললেন, ‘একই খাবার খেয়ে আমি নাতিদীর্ঘই থাকলাম আর সে হলো হাতি দীর্ঘ!’
পথের খোলা খাবার তারা মিয়ার জন্যও ঠিক এমন। কথা বলতে বলতেই পছন্দ করলেন একটি নাইলোটিকা মাছ। অ্যালুমিনিয়ামের ডালায় এক পাশে মুখ রেখে আয়েশে ঝোলে সাঁতার কাটতে থাকা মাছটির দাম ৬০ টাকা। তখনই এক ভিখারি হাত বাড়িয়ে দাঁড়ালেন সেখানে। মুহূর্তে খাবারে জীবাণু যাওয়ার পরিমাণ পরীক্ষা করাতে হলে যেতে হবে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের খাদ্যবিশ্লেষকদের কাছে। এ পরিস্থিতি যাত্রাবাড়ী থেকে শুরু করে রাজধানীর ৩০০ ফুটের অধিকাংশ দোকানের খাবারে। এর মধ্যে চানখাঁরপুল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, শাহবাগ, আগারগাঁওয়ের সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কোনো জায়গায় ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই। কোথাও মাছের আড়তে ব্যবহৃত পানি দিয়ে তৈরি হচ্ছে লাচ্ছি ও শরবত। কোথাও ছিন্নমূল মানুষ, হকার, রিকশাচালক বা শেয়ার রাইডাররা পছন্দ করে বেছে নিচ্ছেন এসব খাবার।
১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর মায়ের দোয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের পাশে পেঁপের শরবত বিক্রি করছিলেন এক ব্যক্তি। সেখানে দাঁড়িয়ে শরবত খেলেন জিগাতলার একজন বাসিন্দা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি এদিকে কাজে এসে আটকা পড়েছেন। অনেকক্ষণ ধরে পথে পথে হেঁটে পিপাসা পাওয়ায় শরবত খাচ্ছেন। জীবাণু আছে জানার পরও খেয়েছেন কারণ, হাতের কাছে আর কিছু পাননি। উল্টো তিনি অভিযোগের সুরে বললেন, ফুটপাতে এসব খাবার বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো নজরদারি নেই। বিপুল জনসংখ্যার একটি দেশের রাজধানীর নিম্ন আয়ের মানুষ নানাভাবেই পথের খাবারের ওপর নির্ভরশীল দাবি করে তিনি বলেন, ‘পথের খাবারের গুণগত মান জানার কোনো উপায় নেই। সচেতনতা নিয়ে প্রচার নেই। দোকানদারেরা নিজেদের পরিশ্রম কমাতে দায় চাপান খদ্দেরের ওপর। তাঁরা খাবারের ওপরের ঢাকনা বারবার সরানোর কষ্ট করতে রাজি নন।’
এই অভিযোগ বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষেরও। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এই বিভাগের দায়িত্ব হচ্ছে, খাদ্যের বিশুদ্ধতা ও বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের খাদ্যের বিশুদ্ধতা পরিবীক্ষণ ও বিচারিক বিভাগের পরিচালক সহদেব চন্দ্র সাহা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেট বা গণমাধ্যমকর্মীদের দেখলে দোকানদারেরা সচেতন হন। নানা রকম কথা বলেন। আসলে নিজেরাই খাবার ঢেকে রাখার পরিশ্রম করতে চান না। প্রতিদিনই মোবাইল কোর্ট নিজস্ব নিয়মে চলে রাজধানীতে। জরিমানাও হয়। তবে পথেঘাটে, রাস্তায় হাজার হাজার রেস্টুরেন্ট। এতগুলো তো আমাদের নিয়ন্ত্রণে একসঙ্গে নিয়ে আসা সম্ভব নয়।’
পরিস্থিতি মোকাবিলায় পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মনিটরিং টিমের কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, রাজধানীকে পাঁচটি জোনে ভাগ করে ৬০ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছে। তাঁরা হচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, শাহবাগসহ বিভিন্ন জায়গায় খাবার তৈরি, ব্যবস্থাপনা–সংশ্লিষ্ট ও বিক্রেতা। সচেতনতা বাড়াতে তাঁদের দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রথম ধাপে ৬০ জনের প্রশিক্ষণের পর পরবর্তী সময় নির্বাচন করা হবে। তবে এই প্রশিক্ষণে আদৌ কোনো কাজ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘জীবাণুতে ভরা পথের খাবার’। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঢাকার প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ পথের খাবার খান। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) ১৪৯টি খাবারের নমুনায় বিপজ্জনক মাত্রায় টোটাল কলিফর্ম ও ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া পেয়েছে।
এর মধ্যে এক সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ভ্রাম্যমাণ কয়েকটি দোকান থেকে পাঁচ রকমের খাবার কিনে দেখা যায়, সব বিক্রেতাই পত্রিকা বা বইয়ের পুরোনো পৃষ্ঠা ব্যবহার করে থাকেন খদ্দেরের হাতে ঝালমুড়ি, সেদ্ধ ডিম বা জিলাপি তুলে দিতে। ওই কাগজগুলোতে থাকে ক্ষতিকর পিগমেন্ট, প্রিজারভেটিভ। যা শরীরের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর।
২০১৫ সালে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া হয়। ‘জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য’-এ রূপকল্পকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। কর্তৃপক্ষ কতটা সক্রিয় তা যে প্রশ্নসাপেক্ষ, এর উদাহরণ রাজধানীর ফুটপাতের উন্মুক্ত অস্বাস্থ্যকর খাবার। আর ক্রেতার পছন্দ তাই খাবার খোলা রাখা হয় এমন বক্তব্য বিক্রয়কর্মীদের। ফলে শিবরাম চক্রবর্তী ও পঞ্চানন চক্রবর্তীর মতো একই খাবার খেয়ে কেউ নাতিদীর্ঘ থেকে যাবেন আর কে হাতি দীর্ঘ হবেন—তা কেউ জানেন না। সচেতন হওয়ার দায়িত্বটা যেন ফুটপাতের খাবারের নিয়মিত ক্রেতা তারা মিয়াদের একার।