হানিফ উড়ালসড়কে উবারের ‘বাড়তি টোল’ আদায়

নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে ঢাকার পুরানা পল্টনে যাওয়ার পথে উবার অ্যাপে মোটরসাইকেলের সেবা নিয়েছিলেন ব্যবসায়ী মো. রোমান মিয়া। এই যাত্রাপথে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসড়ক পাড়ি দিতে হয়। উড়ালসড়কটিতে মোটরসাইকেলের টোল ১০ টাকা। তবে উবার তাঁর কাছ থেকে ৬০ টাকা টোল নেয় বলে অভিযোগ রোমানের। যদিও উবার কর্তৃপক্ষ অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, তারা কোনো ধরনের টোল আদায় করে না।

রোমান মিয়া ২০২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে পুরানা পল্টনে যান। পথে মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের টোল প্লাজায় চালক তাঁকে ১০ টাকা টোল দিতে বলেন। রোমান সে অনুযায়ী ১০ টাকা দেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর তিনি দেখেন, অ্যাপে ১৮১ টাকা ২৭ পয়সা ভাড়ার সঙ্গে আরও ৬০ টাকা যুক্ত করা হয়েছে।

কিন্তু মেয়র হানিফ উড়ালসড়কে মোটরসাইকেলের জন্য নির্ধারিত টোল ১০ টাকা, যা তিনি নিজেই দিয়েছেন। অথচ এরপরও উবার ৬০ টাকা নিয়েছে। যদিও ‘প্রোমোশন’ হিসেবে ১৬ টাকা ৮৯ পয়সা ছাড় দেওয়া হয়।

যানবাহন অনুযায়ী যে পরিমাণ টোল নির্ধারণ করা আছে, সেটাই নিতে হবে। এর বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। বিআরটিএর উচিত বিষয়টি দ্রুত খতিয়ে দেখা।
গোলাম রহমান, সভাপতি, ক্যাব

উবারের অ্যাপে মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ির সেবা পাওয়া যায়। এই ধরনের তিন যানের জন্য মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের নির্ধারিত টোল হচ্ছে যথাক্রমে ১০, ১৮ ও ৬০ টাকা।

রোমান মিয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৭ মে উবারের অ্যাপে উল্লেখিত তিন যানের ভাড়া দেখেন এই প্রতিবেদক। রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড দূরত্বে দেখা যায়, উবার প্রতিটি যানের ক্ষেত্রে ‘এস্টিমেটেড টোল’ নামে ৬০ টাকা ধরে আনুমানিক ভাড়ার হিসাব দেখাচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে উবারের বক্তব্য জানতে ৯ মে ই–মেইল করা হয়। পরদিন ১০ মে ই–মেইলের জবাবে উবার কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা কোনো টোল আদায় করে না। টোলসহ অন্যান্য চার্জ রাইডার বা গ্রাহকই ট্রিপ ফেয়ারের সঙ্গে দিয়ে থাকে। এ ছাড়া অযৌক্তিকভাবে যদি কারও কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় হয়ে থাকে এবং সে–সংক্রান্ত অভিযোগ উবারের অ্যাপে করলে বাড়তি টাকা ফেরত দেওয়া হয় বলেও জানায় তারা।

ই–মেইলের জবাব পাওয়ার পর ওই দিনই কারওয়ান বাজার থেকে যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত দূরত্বে উবারের অ্যাপে আবারও ভাড়া যাচাই করলে দেখা যায়, টোলের বিষয়টি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ‘এস্টিমেটেড টোল’ তারা রাখেনি।

রাইড শেয়ারিং নীতিমালা ২০১৭-তে ভাড়ার ক্ষেত্রে বলা আছে, ‘ট্যাক্সি ক্যাব সার্ভিস গাইডলাইন ২০১০’ অনুযায়ী নির্ধারিত ভাড়া অপেক্ষা বেশি হবে না। ট্যাক্সি ক্যাব গাইডলাইনে ভাড়ার হার কেমন হবে লেখা থাকলেও টোলের বিষয়টির উল্লেখ ছিল না।

দুই সংস্থায় আট মাস ঘোরাঘুরি

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসড়কের টোলসহ উবারের ভাড়ার রসিদ

রোমান মিয়া উবারের এই টোল আদায়ের বিষয়টি সমাধানের জন্য সরকারের দুটি সংস্থায় প্রায় আট মাস ধরে ঘুরছেন। কিন্তু এখনো কোনো সমাধান পাননি।

তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করলে দুই পক্ষের মধ্যে শুনানির ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে উবার কর্তৃপক্ষ তাঁকে বাড়তি টাকা ফেরত দিতে চেয়েছিল বলে দাবি করেন তিনি। রোমান বলেন, ‘আমি টাকা নিতে রাজি হইনি। আমি চাই, তারা অ্যাপেই এটার পরিবর্তন আনুক। নির্ধারিত টোলের বেশি তো তারা নিতে পারে না।’

ভোক্তা অধিকার তাঁকে কোনো সমাধান দিতে পারেনি দাবি করে রোমান বলেন, তাঁকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী গত মার্চ মাসে বিআরটিএতে লিখিত অভিযোগ করেন তিনি। এক মাস পর খোঁজ নিয়ে এর কোনো অগ্রগতি জানতে পারেননি তিনি। পরে চলতি মাসের শুরুতে আবার বিআরটিএর কার্যালয়ে যান। পরে ৭ মে বিআরটিএ থেকে মুঠোফোনে বার্তা পান যে তাঁর অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়েছে।

রোমান মিয়া বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান দুটি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। বিআরটিএর ভূমিকায় তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, অনিয়মগুলো দেখাই কিন্ত তাদের দায়িত্ব।
ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী সেবার বিষয়গুলোও তারা দেখে। যেখানে মূল্যের বিনিময়ে ভোক্তা সেবা গ্রহণ করেন। তাদের এই সেবার মধ্যে পরিবহনও রয়েছে।

ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরে ১১ মে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে কর্মকর্তা রোমান মিয়ার অভিযোগটি দেখেছেন, তিনি ছুটিতে রয়েছেন। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ওই কর্মকর্তা ফিরলে তিনি বিষয়টি সম্পর্কে বলতে পারবেন।

বিআরটিএর ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় যোগাযোগ করে জানা যায়, উবারের বিরুদ্ধে অভিযোগটি তারা পর্যালোচনা করে দেখছে। তবে সংস্থাটির পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগের বিষয়টি তাঁর জানা নেই। কোনো অভিযোগ এলে তাঁরা তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবেন। রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সড়কে টোল আদায়ের পদ্ধতি কী, জানতে চাইলে তিনি জানান, বিষয়গুলো এখনো নতুন।

বিআরটিএর উচিত বিষয়টি দ্রুত খতিয়ে দেখা

রাইড শেয়ারিং নীতিমালা অনুযায়ী যাত্রীর সঙ্গে যদি কোনো সমস্যা তৈরি হয়, রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান যদি সমস্যার সমাধান করতে না পারে, সে ক্ষেত্রে বিআরটিএ আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।

বিষয়টি নিয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যানবাহন অনুযায়ী যে পরিমাণ টোল নির্ধারণ করা আছে, সেটাই নিতে হবে। এর বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। বিআরটিএর উচিত বিষয়টি দ্রুত খতিয়ে দেখা।