কান থেকে হাত নামাতেই পারছেন না বেওলা খাতুন (৬০)। হাত একটু সরাতেই গুলির শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। সীমান্তের ওপাশ থেকে টানা গোলাবর্ষণ ও গুলির শব্দ। সবার মধ্যেই আতঙ্ক আর সতর্কতা। মাথা বাঁচিয়ে কোনোরকমে বেওলা খাতুনের বাড়ির সামনে যখন এসে পৌঁছালাম, তখন তিনি কানে হাত দিয়ে আছেন। গোলাগুলির শব্দের মধ্যে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে রীতিমতো চেঁচাতে হলো।
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের মিয়ানমার সীমান্তের রহমতের বিল এলাকায় বেওলা খাতুনের বাড়ি। সেখান থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরেই মিয়ানমারের কুমিরখালী। সেখানকার যুদ্ধ পরিস্থিতির আঁচ লেগেছে এখানেও। গোলাগুলি চলছে পাঁচ দিন ধরে। আর এর মধ্যেই এই বৃদ্ধা আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। আজ মঙ্গলবার দুপুরে বেওলা খাতুনের সঙ্গে কথা হয় তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। সীমান্তের ওই এলাকা দিয়ে মিয়ানমারের বিজিপি ও সেনাসদস্যদের অনেকেই পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে তাই বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) সদস্যরা পাহারা দিচ্ছেন। এপারের উৎসুক লোকজন আর সংবাদকর্মীরাও ভিড় করেছিলেন ওই এলাকায়। সবারই দৃষ্টি সীমান্তদের ওপারে।
কেমন আছেন, জানতে চাইলে বৃদ্ধা বেওলা খাতুন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় চেঁচিয়ে বললেন, শুক্রবার থেকে টানা পাঁচ দিন ধরে গুলির শব্দ আসছে সীমান্ত থেকে। আজ সকাল ১০টার দিকে তাঁর ছাদে গুলি এসে পড়ে। এতে ফুটো হয়ে গেছে ঘরের টিন। কখন খারাপ কিছু ঘটে, এই ভয়ে দিন কাটছে তাঁর। গুলির শব্দ থেকে বাঁচতে বালিশেও কান চাপা দিয়েছেন।
বেওলা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ছেলের বউ আর নাতি-নাতনিদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। পরিস্থিতি বুঝে তিনিও চলে যাবেন।
বেওলার বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরে মমতাজ বেগমের বাড়ি। বাড়ির উঠানে বসে তিনিও কানে হাতচাপা দিয়ে আছেন। মমতাজ বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আতঙ্কে আছেন। গুলির শব্দে পরিবারের ছোট বাচ্চারা কান্না করছে। নিরাপত্তার জন্য তাঁদের সরিয়ে নেওয়া উচিত। মমতাজের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই মন্তব্য করলেন সানোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ‘জান বাঁচাতে অনেক আগে চলে যেতাম। কিন্তু বাড়িঘর, গরু, ছাগল রেখে কীভাবে যাব।’
জানতে চাইলে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুরুদ্দিন চৌধুরী নিজ কার্যালয়ে আজ প্রথম আলোকে বলেন, কিছুক্ষণ পরপর গুলি শব্দ হচ্ছে। এলাকার লোকজন আতঙ্কে আছেন। অনেকের বাড়িঘরে এসে গুলি পড়ছে। নিরাপত্তার জন্য তাঁদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া উচিত।
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সংঘর্ষ চলছে । ইতিমধ্যে সীমান্তের ওপারে বিজিপিকে হটিয়ে তুমব্রু রাইট ক্যাম্প ও ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি আরাকান আর্মি দখলে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। দুই পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে সোমবার ঘুমধুম ইউনিয়নে জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরের ওপর মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হয়েছেন। নিহত দুজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ।
নিহত নারী জলপাইতলী গ্রামের বাদশা মিয়ার স্ত্রী হোসনে আরা (৫৫)। নিহত রোহিঙ্গার নাম নবী হোসেন (৬৫)। স্থানীয় সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, এর আগে গত ২৯ ও ৩১ জানুয়ারি ঘুমধুম সীমান্তের ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। সে সময় মর্টার শেল ও গোলার অন্তত চারটি অংশ তুমব্রু, কোনারপাড়া ও পশ্চিম ঘুমধুমে এসে পড়ে। ইতিমধ্যে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ২২৯ জন বাংলাদেশে চলে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে কিছু আহতও আছেন। তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।