সংবাদমাধ্যমে নারীর উপস্থিতি কম। সংবাদমাধ্যমে প্রতিটি পর্যায়ে সব সময় নারীদের প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমে তৈরি আধেয়গুলোতে লিঙ্গভিত্তিক (জেন্ডার) সংবেদনশীলতার ঘাটতি থাকে। সংবাদমাধ্যমে যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে নারীসহ অন্যান্য জেন্ডার বৈচিত্র্যের মানুষের সমতা নিশ্চিত করতে নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়ন করা জরুরি।
আজ রোববার রাজধানীতে ‘সংবাদমাধ্যমে জেন্ডারবিষয়ক অঙ্গীকার সনদ’ প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন বক্তারা। দ্য ডেইলি স্টারের আজিমুর রহমান সম্মেলন কক্ষে ‘জেন্ডার সমতা ও ন্যায্যতার জন্য সংবাদমাধ্যম’ শিরোনামে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মিডিয়া রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই)।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, সংবাদমাধ্যমে জেন্ডারবিষয়ক অঙ্গীকার সনদ তৈরিতে ১৫টি দলভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে রাজধানী ও জেলা পর্যায় থেকে ১২৯ অংশীজনের মতামত ও পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। সনদ তৈরিতে এমআরডিআইয়ের উদ্যোগে সাংবাদিকতার শিক্ষক, সংবাদমাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহীতা, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, উন্নয়নকর্মী এবং জেন্ডার ও আইন-বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ১০ জনের একটি দল গঠন করা হয়।
এই দলের নেতৃত্বে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন। অন্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, সাংবাদিক ও প্রশিক্ষক কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা, চ্যানেল ২৪-এর নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ফউজুল আজিম, ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি বিভাগের কর্মসূচি প্রধান মাসুমা বিল্লাহ, মানবাধিকারকর্মী শীপা হাফিজা, প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম এবং অধিকারকর্মী হোচিমিন ইসলাম।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস বলেন, সমাজের বিভিন্ন দিকের প্রতিফলন ঘটানো সংবাদপত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গণতন্ত্রের জন্য নারী ও পুরুষকে সমানভাবে তুলে ধরা জরুরি। তাই গণতন্ত্রের জায়গাগুলোকে উৎসাহিত করতে এবং অনেকের কণ্ঠস্বর শোনা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। তাই সংবাদপত্রে নারী ও অন্য জেন্ডারের কথা ঠিকভাবে না এলে জেন্ডার–সমতা নিশ্চিত করতে কার্যকর পরিবর্তন আনা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, সংবাদমাধ্যমে সব সময় প্রতিটি পর্যায়ে নারীদের প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করা হয় না। এই সনদ করা হয়েছে নারীসহ সব লিঙ্গভিত্তিক মানুষের জন্য ন্যায্য ও সমতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে, যাতে সংবাদমাধ্যমে সব জেন্ডারের ন্যায্য ও সংবেদনশীল উপস্থিতি থাকে। যেসব আধেয় তৈরি হয়, সেসবের মধ্যে যেন সমতা ও ন্যায্যতার বিধান নিয়ে আসা হয়। সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি তিনি আহ্বান জানান, যেন এই জেন্ডারবিষয়ক অঙ্গীকার সনদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের নীতিমালা তৈরি করে। গৎবাঁধা ধারণার বাইরে জেন্ডারের কথা ও দৃষ্টিকোণ থেকে যেন সংবাদ তৈরি করা হয়।
সনদে ৫ বিষয়ে আলোকপাত
অংশগ্রহণে সমতা, পরিবেশিত সংবাদে জেন্ডারের উপস্থিতি ও উপস্থাপন, নীতিমালা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা এবং পরিবীক্ষণ—এই পাঁচ বিষয়ে অঙ্গীকার সনদে আলোকপাত করা হয়েছে।
সনদে অংশগ্রহণে সমতার ক্ষেত্রে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা, ন্যায্য সমবেতন, জেন্ডার সংবেদনশীল আচরণবিধি বা নীতিমালা তৈরি, কোনো জেন্ডারকে হেয় বা বঞ্চিত না করার ব্যাপারে সতর্ক থাকা, চাহিদা অনুযায়ী আলাদা টয়লেট, শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র রাখা, মাতৃত্বকালীন বা সমতুল্য অন্য ছুটি দেওয়া, ছুটিফেরত কর্মীর প্রতি বৈরিতার অবসান ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে।
পরিবেশিত সংবাদে জেন্ডারের উপস্থিতি ও উপস্থাপন বিষয়ে সনদে বলা হয়েছে, সংবাদে বিশেষজ্ঞ, মুখপাত্র, সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সব জেন্ডারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো শব্দ, বর্ণনা, লেখার সুর বা বিন্যাসের মাধ্যমে কোনো জেন্ডারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবমাননা যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের সংবাদপ্রতিষ্ঠান থেকে যেন অহেতুক কোনো অবমাননামূলক সংবাদ, ছবি, ভিডিও বা সংবাদের অংশ প্রকাশিত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
সনদের নীতিমালার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, নীতিমালায় প্রাসঙ্গিক আইন, বিধি ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে বলা হয়েছে, সব কর্মীর সুরক্ষায় সতর্ক থাকতে হবে। কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালের হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে কার্যালয়ে একটি অভিযোগ প্রতিকার কমিটি গঠন করতে হবে। পরিবীক্ষণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সনদে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তার তদারকি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
সনদ তৈরিতে নেতৃত্ব দেওয়া অধ্যাপক গীতা আরা নাসরীন বলেন, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে, সবাই মিলে চাইলে পরিবর্তন সম্ভব। কারণ, সংবাদমাধ্যমে প্রত্যেকেই মনে করেন, জেন্ডার নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিতে সমস্যা রয়েছে। প্রত্যেকেই এ অবস্থার পরিবর্তন চান। ফলে সামনে একটি নীতিমালা থাকলে সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো যা করা প্রয়োজন মনে করবে, তা কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। সাংবাদিকতা বিভাগের মেয়েরা কেন সাংবাদিকতায় আসতে চাইছেন না, কী ধরনের সংবাদক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে যে তাঁরা আসতে চাইছেন না, সেটা ভাবা দরকার।
সনদ তৈরি কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিদেশে থাকার কারণে অধ্যাপক কাবেরী গায়েন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে শীপা হাফিজা বলেন, পরিবর্তন যে সম্ভব এই আলোচনাই আগে কখনো হয়নি। একটি প্রতিষ্ঠানের নারী কর্মীরা যদি উপকৃত হন, সেই সুযোগের ভাগীদার সমাজও হবে।
কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা বলেন, সনদ তৈরির মাধ্যমে কাজটি শুরু হলো। তবে রাস্তা অতটা সহজ নয়। সনদ বাস্তবায়নের জন্য অনেক জায়গায় পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। মানুষের চিন্তাভাবনার মধ্যে পরিবর্তন হতে হবে।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, ২৩ নভেম্বর সংবাদমাধ্যমে জেন্ডারবিষয়ক অঙ্গীকার সনদটি ৫২টি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২০টি প্রতিষ্ঠান সনদে স্বাক্ষর করেছে। সেগুলো হচ্ছে প্রথম আলো, ইত্তেফাক, সমকাল, দ্য ডেইলি স্টার, আজকের পত্রিকা, মানবজমিন, ঢাকা ট্রিবিউন, বাংলা ট্রিবিউন, দেশ রূপান্তর, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, যমুনা টেলিভিশন, ঢাকা পোস্ট ডটকম, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর, চ্যানেল আই এবং আঞ্চলিক গণমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে হবিগঞ্জের প্রভাকর, নাটোরের উত্তর কণ্ঠ, যশোরের গ্রামের কাগজ ও লোকসমাজ এবং রাজশাহীর সোনার দেশ।
উন্মুক্ত আলোচনায় বক্তারা
আজকের পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, সামাজিক সীমাবদ্ধতা ও শৈথিল্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রে অনেক অসমতা শনাক্ত করা যায় না। দেশে কয়েক শ গণমাধ্যম আছে। জেন্ডার–সমতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা জানাতে সেসব গণমাধ্যমেও এই সনদের অনুলিপি পৌঁছে দেওয়া দরকার।
সরকার গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, গণমাধ্যমে কী ধরনের সংস্কার আনা উচিত, বোঝার জন্য তিনি বিভিন্ন পর্যায়ের বক্তব্য শুনছেন, জানার চেষ্টা করছেন ও পড়ছেন।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, তিন দশক ধরে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর মনে হয়েছে, এই সমাজ হলো ‘বয়েজ ক্লাব’ (পুরুষদের ক্লাব)। অসমতা শুধু সংবাদমাধ্যমে নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে। তাই নারী ও প্রান্তিক জেন্ডারদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক—বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে হবে।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন বলেন, দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জেন্ডার–সমতা নিশ্চিত করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণেও জেন্ডার–সমতা থাকতে হবে, যাতে ভালো ও গুণী কর্মীকে হটিয়ে দেওয়া না যায়।
নিউজ নেটওয়ার্কের সম্পাদক শহীদুজ্জামান বলেন, সংবাদমাধ্যমে লিঙ্গভিত্তিক সমতা নিশ্চিত করতে হলে লাইসেন্স দেওয়ার সময় সমানভাবে নিয়োগের বিধান যুক্ত করা যেতে পারে। বিজ্ঞাপণদাতারাও যে প্রতিষ্ঠানে জেন্ডার–সমতা রয়েছে, সেখানে বিজ্ঞাপন দেবেন—এমন শর্ত দিতে পারেন।
আঞ্চলিক পত্রিকা যশোরের দৈনিক লোকসমাজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আনোয়ারুল কবির বলেন, ঢাকার বাইরের সংবাদমাধ্যমে চিত্র ভিন্ন। কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার–সমতা নিশ্চিত করতে সেখানে অর্থনৈতিক ও চলাফেরার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
সংবাদমাধ্যমে পুরুষের প্রাধান্য বেশি উল্লেখ করে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, সংবাদমাধ্যমকে আরও বেশি জেন্ডার অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে।
এ পর্বে আরও বক্তব্য দেন দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ, যমুনা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহিম আহমেদ, দ্য ডেইলি স্টারের যুগ্ম সম্পাদক আশা মেহরীন আমিন, চ্যানেল আইয়ের জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক মীর মাসরুর জামান, ইন্টারনিউজ বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ শামীম আরা, রাজশাহীর দৈনিক সোনার দেশের সম্পাদক আকবারুল হাসান মিল্লাত, যশোরের দৈনিক গ্রামের কাগজের সম্পাদক মোবিনুল ইসলাম, নাটোরের দৈনিক উত্তর কণ্ঠের সম্পাদক মো. রেজাউল করিম, দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি মীর জুনায়েদ জামাল এবং সিভিক এনগেজমেন্ট ফান্ডের পরিচালক আদি ওয়াকার।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এমআরডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান।