মাসফিকুস সালেহীন
মাসফিকুস সালেহীন

অভিমত

বন্যার বড় কারণ অস্বাভাবিক বৃষ্টি

এবারের বন্যার একটি বড় কারণ হচ্ছে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে লঘুচাপের কারণে এবার প্রবল বর্ষণ হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের মুহুরী, ফেনী, গোমতী নদীর মাধ্যমে (যাদের ক্যাচমেন্টের বেশির ভাগ অংশ ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থিত) ফেনী ও কুমিল্লা জেলায় ব্যাপক বন্যা হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের অভ্যন্তরের বৃষ্টি। আমাদের মনে থাকবে, জুলাই মাসের শেষ দিকে এসেও এই নদীগুলোর পানি বেড়েছিল এবং বিপৎসীমা অতিক্রম করেছিল। এতে প্লাবনভূমির পানির আধারগুলো প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

এর মধ্যে ১৯ আগস্ট থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। ২০ আগস্ট বৃষ্টির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এসব এলাকায় এদিন ১৫০ থেকে ৩০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। কুমিল্লায় ২১০ মিলিমিটার, অমরপুরে (গোমতী ক্যাচমেন্টের ওপরের দিকে) ২৬৭ মিলিমিটার আর মুহুরী নদীসংলগ্ন পরশুরামে ৩০৪ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। ২১ আগস্ট বৃষ্টি একটু কমলেও সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় আবার বৃষ্টি বেড়ে যায়। আশা করছি, দু–এক দিনের মধ্যে বৃষ্টি কমবে, পানিও কমতে শুরু করবে।

তথ্য আদান–প্রদানে পারস্পরিক সহযোগিতা ভালোভাবে কাজ করছে। এ কারণে বন্যার পূর্বাভাস আগের তুলনায় ভালো হয়েছে। তবে এটা ঠিক, ভারতের কিছু ব্যারাজ বা ড্যামের ফটক খোলার তথ্য পেলে বাংলাদেশের বন্যার প্রস্তুতি আরও শক্তিশালী হতো। তথ্য আদান–প্রদানের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে এটি আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

বন্যা পরিস্থিতির অবনতির পেছনে আরেকটি কারণ আলোচনায় এসেছে। বলা হচ্ছে, ভারতের ত্রিপুরার ধলাই জেলায় গোমতী নদীর ওপরে থাকা ডুম্বুর ড্যামের ফটক খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বন্যা হয়েছে। কিন্তু শুধু এই ড্যামের ফটক খুলে দেওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এ রকম উপসংহারে যাওয়া ঠিক হবে না। যে বাঁধের কথা বলা হচ্ছে, তা বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে। এটির তুলনামূলক আকার, পানি সংরক্ষণের ক্ষমতা, দূরত্ব ও কৌশলগতভাবে ছেড়ে দেওয়া পানির পরিমাণ এবং ক্যাচমেন্টজুড়ে প্রবল বৃষ্টি বিবেচনায় নিলে প্রতীয়মান হয় যে ক্যাচমেন্টে কী পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, সেটিই বাংলাদেশের সীমানায় বন্যার প্রবাহকে নির্ধারণ করেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ফেনী নদীতে কোনো ড্যাম নেই এবং নদীগুলোয় যে কয়েকটি ব্যারাজ আছে, সেগুলো বন্যায় কোনো ভূমিকা রাখেনি। কারণ, ব্যারেজগুলোর সব ফটক এ সময় খোলা ছিল।

উজানের দেশ হিসেবে ভারতের তথ্য দেওয়া দরকার। একসময় আমরা সেভাবে তথ্য পেতাম না। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ৮–১০ বছর ধরে ভারতের অনেকগুলো পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশন থেকে বাংলাদেশকে তথ্য সরবরাহ করা হয়।

বৃষ্টির পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে আমরা অতটা নির্ভুল (অ্যাকুরেসি) পূর্বাভাস দিতে পারি না। এটি একটি বড় সমস্যা। এ জায়গায় উন্নতি করতে হবে। কীভাবে এটি করা যায়, তা আমাদেরই করতে হবে, গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।

তথ্য আদান–প্রদানে পারস্পরিক সহযোগিতা ভালোভাবে কাজ করছে। এ কারণে বন্যার পূর্বাভাস আগের তুলনায় ভালো হয়েছে। তবে এটা ঠিক, ভারতের কিছু ব্যারাজ বা ড্যামের ফটক খোলার তথ্য পেলে বাংলাদেশের বন্যার প্রস্তুতি আরও শক্তিশালী হতো। তথ্য আদান–প্রদানের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে এটি আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

২০২২ সালে সিলেট ও সুনামগঞ্জে হওয়া বন্যার সঙ্গে এবারের বন্যার তেমন একটা তফাত নেই। তখনো প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল। এ রকম বৃষ্টির ফলে কী ধরনের বন্যা হতে পারে, তার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি থাকা দরকার। বন্যার পানি যাতে বিস্তৃত এলাকায় না ছড়ায়, সে জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি রাখতে হবে।

বন্যার আর্লি ওয়ার্নিং বা আগেভাগে সতর্ক করার কোনো বিকল্প নেই। আর আগেভাগে এ ধরনের বন্যার পূর্বাভাস পেতে হলে বৃষ্টির পূর্বাভাস পেতে হবে। কারণ, আমাদের নদীগুলোর অববাহিকা এলাকা ছোট। পানিও দ্রুত আসে। তবে এখানে একটি দুঃখের বিষয় হলো, বৃষ্টির পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে আমরা অতটা নির্ভুল (অ্যাকুরেসি) পূর্বাভাস দিতে পারি না। এটি একটি বড় সমস্যা। এ জায়গায় উন্নতি করতে হবে। কীভাবে এটি করা যায়, তা আমাদেরই করতে হবে, গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।

বন্যার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পূর্বপ্রস্তুতি। ফেনীর কিছু উপজেলার মানুষের জন্য এ ধরনের বন্যা একেবারে নতুন। সে জন্য কোনো প্রস্তুতি ছিল না। বন্যা মোকাবিলায় ‘ইভাকুয়েশন রুট’ আগেভাগে পরিকল্পনা করে রাখা দরকার। এটি করা থাকলে বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার করা সহজতর হয়। অন্যদিকে বন্যা যাতে দীর্ঘস্থায়ী না হয়, সে জন্য পানি নামার পথগুলো ঠিক রাখতে হবে। বেশির ভাগ জায়গায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা একটি সমস্যা। সার্বিকভাবে আগাম সতর্কতা এবং পূর্বপ্রস্তুতি যত ভালো হবে, বন্যার ক্ষয়ক্ষতি তত কম হবে। এটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

  • অধ্যাপক মাসফিকুস সালেহীন, পানিবন্যা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বুয়েট