চাল ‘উদ্বৃত্ত’, তবু বাড়ছে দাম

চালের উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে শুভংকরের ফাঁকি রয়েই গেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে চালের উৎপাদন যথেষ্ট ভালো, চাহিদার চেয়ে কমপক্ষে ৫০ লাখ টন বেশি। ফলে আমদানির দরকার নেই। কিন্তু চাল উদ্বৃত্ত থাকার পরও দেশের বাজারে দফায় দফায় দাম বাড়ছে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর হিসাবে বাংলাদেশে চলতি বছর চাহিদার তুলনায় চালের উৎপাদন কিছুটা কম। গমের আমদানি কমে যাওয়ায় বেড়েছে চালের চাহিদা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) হিসাবে চলতি অর্থবছরে মোট ৪ কোটি ১২ লাখ টন চাল উৎপাদন হতে পারে। এর মধ্যে বোরো ২ কোটি ৯ লাখ টন, আউশ ৩০ লাখ টন ও আমন ১ কোটি ৭০ লাখ টন। আর দেশে চালের চাহিদা ৩ কোটি ৫০ লাখ টনের কাছাকাছি। সেই হিসাবে দেশে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা।

বাজারে রমজানের এই সময়ে চালের চাহিদা কিছুটা কম থাকে। এতে দাম বাড়ার কথা নয়। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে দাম ধীরে ধীরে বাড়ছে।

অপরদিকে ইউএসডিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর (২০২৩-২৪) শেষে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন ৩ কোটি ৬৩ লাখ টনে দাঁড়াবে। একই সময়ে ভোগের পরিমাণ হবে ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন। অর্থাৎ ভোগ আর উৎপাদনের মধ্যে পার্থক্য ১৩ লাখ টন। চাল উৎপাদন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে ইউএসডিএর উৎপাদন তথ্যে বড় একটি ফাঁরাক রয়েছে।

বাজারে রমজানের এই সময়ে চালের চাহিদা কিছুটা কম থাকে। এতে দাম বাড়ার কথা নয়। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে দাম ধীরে ধীরে বাড়ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মন্ত্রণালয় শুরুতে চালকলের মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে। চালকলের মালিকেরা দাম না বাড়ানোর প্রতিজ্ঞা করেন। তারপরও দাম কমেনি; বরং বেড়েছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, প্রতি কেজি চালের দাম গত এক সপ্তাহে দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে সরকার চালের দাম কমাতে পুরোনো কৌশলই বেছে নিয়েছে। আমদানি শুল্ক ৬৭ থেকে ১৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। প্রাথমিকভাবে ৩০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৩ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। আরও কিছু প্রতিষ্ঠানকে আমদানির অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে দুই লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হতে পারে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, প্রতি কেজি চালের দাম গত এক সপ্তাহে দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে চালের সংকট নেই। আর এপ্রিলে বোরো ধান উঠবে। তারপরেও হঠাৎ চালের দাম কিছুটা বেড়ে গেছে। আগামী এক মাসের মধ্যে যাতে দাম আর না বাড়ে, সে জন্য আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি মজুত করে চালের দাম আর বাড়াতে না পারে, সে জন্য আগাম ব্যবস্থা হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে বাজারে মোটা চালের কেজি গত এক সপ্তাহে ২ টাকা বেড়ে ৫২ টাকা হয়েছে। আর সরু চাল তিন টাকা বেড়ে ৬৫ থেকে ৭৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে বাজারে ঘুরে এ ধরনের চালের দাম আরও বেশিতে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর রামপুরা ও মালিবাগ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহ দুই আগে যে মোটা চালের (স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি ৫০-৫১ টাকা ছিল তা এখন ৫২-৫৩ টাকা। মাঝারি মানের চালের (পাইজাম ও বিআর–২৮) কেজি ৫৫-৫৬ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৭-৬০ টাকা। দুই সপ্তাহে বাজারে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে মাঝারি মানের চালের। কেজিপ্রতি মাঝারি মানের চালের দাম ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

আর মিনিকেট ও নাজিরশাইলের মতো সরু চালের কেজিপ্রতি দাম ৬২-৭৮ টাকা থেকে বেড়ে ৬৪-৮০ টাকা হয়েছে। বাজারে নাজিরশাইল চালের নানা ধরন আছে। মানভেদে সেগুলো অবশ্য আরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

দেশের অন্যতম বড় মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে পাইকারিতে সপ্তাহের ব্যবধানে মিনিকেট ও বাসমতী চাল কেজিতে ২ টাকা বেড়েছে। অপরিবর্তিত রয়েছে বিআর–২৮ চালের দাম।

বাংলাদেশ অটো, হাসকিং, মেজর চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এইচ আর খান পাঠান প্রথম আলোকে বলেন, চালের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য চালকলের মালিকদের চাপ দেওয়া আর চাল আমদানির সুযোগ দেওয়ার বাইরে আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারত। বড় চাল ব্যবসায়ীদের কাছে ও মোকামে চাল মজুত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল।

বাজারে চালের সংকট নেই। আর এপ্রিলে বোরো ধান উঠবে। তারপরেও হঠাৎ চালের দাম কিছুটা বেড়ে গেছে। আগামী এক মাসের মধ্যে যাতে দাম আর না বাড়ে, সে জন্য আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
মো. ইসমাইল হোসেন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব

আমদানি নিয়ে দোলাচল

চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি দেশে একবার চালের দাম বেড়েছিল। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে তখন দাম কিছুটা কমে আসে। এখন আবার বাজার বাড়তির দিকে।

বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার চাল আমদানির পথে গেছে। ইতিমধ্যে ৩০টি প্রতিষ্ঠান চাল আমদানির অনুমতি নিয়েছে। তাদের বড় অংশ যশোর, সিলেট ও চট্টগ্রামের। তবে বড় আমদানিকারকদের অনেকে এবার চাল আনছেন না।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে বিশ্ববাজারে চালের বাড়তি দামের কারণে গত এক বছরে বাংলাদেশে কোনো সেদ্ধ চাল আমদানি হয়নি। যেখানে ২০২১ ও ২০২২ সালে দেশে ৮ থেকে ১০ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছিল।

দেশের অন্যতম শীর্ষ চাল আমদানিকারক চিত্ত মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন আমরা ভারত থেকে বেশির ভাগ চাল আনতাম। দাম কম ও আমদানি খরচ কম হওয়ায় দেশে এনে পোষাত। কিন্তু ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করার পর আমাদের তো থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার ছাড়া অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানির উপায় নেই। আর সেখান থেকে চাল আনতে গেলে মোটা চালের দাম কেজিতে ৬০ থেকে ৭০ টাকা পড়বে। তাই এবার আমরা আমদানি করছি না।’

এফএওর চলতি মার্চে প্রকাশ করা খাদ্যের দামবিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি দামে বিশ্ববাজারে চাল বিক্রি হচ্ছে। বিশ্বের বেশির ভাগ চাল রপ্তানিকারক দেশে চালের দাম টনপ্রতি ৫৬০ থেকে ৬৭০ ডলার। জাহাজীকরণ ও শুল্ক মিলিয়ে বাংলাদেশে ওই চাল আমদানি করতে প্রতি কেজির দাম ৬০ থেকে ৭৫ টাকা পর্যন্ত পড়বে। মূলত ভারত সুনির্দিষ্ট কিছু দেশ ছাড়া বিশ্ববাজারে চাল রপ্তানি বন্ধ রাখায় চালের দাম হঠাৎ বেড়ে গেছে।

বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার চাল আমদানির পথে গেছে। ইতিমধ্যে ৩০টি প্রতিষ্ঠান চাল আমদানির অনুমতি নিয়েছে। তাদের বড় অংশ যশোর, সিলেট ও চট্টগ্রামের। তবে বড় আমদানিকারকদের অনেকে এবার চাল আনছেন না।

ধানের দাম কমলেও চালে কমছে না

দেশের অন্যতম বড় চাল উৎপাদন কেন্দ্র নওগাঁ। এ জেলায় গত এক সপ্তাহে প্রতি মণ ধানের দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা কমেছে। কিন্তু কমেনি চালের দাম। নওগাঁয় চালের মোকামে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বুধবার প্রতি মণ (৪০) স্বর্ণা ধান বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৪২০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে যার দাম ছিল ১ হাজার ৪৬৫ থেকে ১ হাজার ৪৭০ টাকা। জিরাশাইল ও কাটারিভোগ ধানের দাম প্রতি মণ ৩০ থেকে ৪০ টাকা কমে বর্তমানে ১ হাজার ৬২০ থেকে ১ হাজার ৬৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ধানের বাজার নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। চালের বাজারে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে প্রভাব পড়বে।

ধানের বাজার নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। চালের বাজারে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে প্রভাব পড়বে।
ফরহাদ হোসেন চকদার, নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক

উৎপাদন, ভোগ ও মজুতের সঠিক হিসাব করা দরকার

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে চালের দাম এখন অনেক বেশি। সামনে হয়তো আরও বাড়তে পারে। তাই আগাম সতর্কতা হিসেবে সরকার আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে আমরা দেখেছি, সব সময় কৃষি মন্ত্রণালয় উৎপাদন বাড়িয়ে দেখায়। খাদ্য মন্ত্রণালয় ঘাটতির কথা বলে। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় করে সঠিক উৎপাদন, ভোগ ও মজুতের হিসাব করা দরকার। নয়তো চালের দাম নিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের আরও পড়তে হবে।’

[প্রতিবেদন লিখতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কুষ্টিয়া ও প্রতিনিধি, নওগাঁ]