রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ গত ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের সামনে এভাবে বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন। এ সময় পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ গত ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের সামনে এভাবে বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন। এ সময় পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন

ওয়েবিনারে বক্তারা

বিচার যাতে বিতর্কমুক্ত হয়

১ থেকে ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, এটি দিবালোকের মতো সত্য। এই অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করতে সংশ্লিষ্ট আইনে কিছু সংশোধনী আনা প্রয়োজন। যাতে বিচার আন্তর্জাতিক মানের এবং বিতর্কমুক্ত হয়। ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ জুলাই ১-৩৬, ২০২৪: কী হবে বিচারপ্রক্রিয়া?’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে।

শনিবার দুপুরে ‘ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের’ উদ্যোগে এই ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়।

ওয়েবিনারে মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটি লন্ডনের স্কুল অব লর লেকচারার মানজিদা আহমেদ বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের বিষয়টি দিবালোকের মতো সত্য। দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই অপরাধের বিচার করতে হলে কিছু ক্ষেত্রে সংজ্ঞায়নে পরিবর্তনসহ আইনে অনেকগুলো সংশোধনী আনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিরও অধিকার রয়েছে; কিন্তু এখানে সেই অধিকার সীমিত। এই ট্রাইব্যুনালের বর্তমান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আগে ডিফেন্সের (আসামিপক্ষে) সঙ্গে কাজ করেছেন, তিনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানেন; কিন্তু ‘প্রিজাম্পশন অব ইনোসেন্স’ (দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত নিরাপরাধ বিবেচনা করা)–এর বিষয়টি অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এখানে ‘রিভেঞ্জ’ (প্রতিশোধ)–এর মতো একটা ব্যাপার হতে পারে। এসব কাটাতে চাইলে আইসিসিতে বিচার করাটা সবচেয়ে ভালো বলে তিনি মনে করেন।

তবে আইসিসিতে বিচার করার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করেন লন্ডনের স্কুল অব লর শিক্ষক মানজিদা আহমেদ। তিনি বলেন, সেখানে বিচারপ্রক্রিয়া হবে দীর্ঘ, অনেক বছর সময় লাগবে। অভিযুক্ত ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে বিচার করা যায় না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) বা হাইব্রিড ট্রাইব্যুনালে জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা যায়। হাইব্রিড ট্রাইব্যুনাল হলো জাতিসংঘের মাধ্যমে বাংলাদেশে ট্রাইব্যুনাল তৈরি করা।

তবে আইসিসিতে বিচারের পক্ষে নিজের অবস্থান তুলে ধরে মানজিদা আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালে যেভাবে মামলা ফাইল (অভিযোগ দায়ের) করা হচ্ছে, তিনি এর পক্ষে নন। কারণ, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। এ ধরনের দেশি ট্রাইব্যুনালের বিচারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।

আলোচনায় অংশ নিয়ে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি–বাংলাদেশের আইন বিভাগের শিক্ষক কাজী ওমর ফয়সাল অবশ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আইসিসিতে করার বিপক্ষে মত দেন। আইসিসিকে তিনি কার্যকর বিকল্প মনে করেন না। তাঁর মতে, আইসিসি ক্ষেত্রবিশেষে স্বৈরশাসকদের পুনর্বাসনে সহায়তা করেছে।

ওমর ফয়সাল বলেন, যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা আছে, বর্তমান সরকার সেগুলো রহিত করতে চাইছে। অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু সংশোধনী প্রস্তাব ইতিমধ্যে উপস্থাপন করেছে। তবে তিনি মনে করেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করার ক্ষেত্রে সম্ভাবনার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জও আছে। প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো বিচারপ্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানের করা। এ জন্য আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার পরামর্শ দেন তিনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, আইসিসিতে বিচার করা হলে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে বিচার করা যাবে না। এটা হলে মানুষ হয়তো মনে করবে, এই সরকার আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

এই ওয়েবিনারে সূচনা বক্তব্যে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ার অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান বলেন, ১–৩৬ জুলাই যেভাবে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। একইভাবে ছাত্র ও তরুণেরা যে সাহস দেখিয়েছেন, সেটিও ছিল অভূতপূর্ব।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মনির হায়দার বলেন, দেশে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আছে। সেটি কোন পটভূমিতে, কী ধরনের অপরাধের বিচারের জন্য গঠন করা হয়েছিল, তা কারও অজানা নয়। অজানা ছিল এই ট্রাইব্যুনালে নতুন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যেতে হবে। যাঁরা এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন, তাঁরাও হয়তো কখনো কল্পনা করেননি একদিন এই ট্রাইব্যুনালে তাঁরা আসামির কাঠগড়ায় আসবেন।