৫২ বছর পর মো. বাকের আলী দাঁড়ালেন ঠিক সেই জায়গাটিতে। যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের অংশ হয়েছিলেন। মেহেরপুরের সেই আমবাগানের নাম তখন পর্যন্ত ছিল ‘বৈদ্যনাথতলা’। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সকাল সাড়ে নয়টার দিকে একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান হয় সেখানে। নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ করেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। বাংলাদেশ সরকার পরবর্তী সময়ে ‘মুজিবনগর সরকার বা প্রবাসী সরকার’ নামেও পরিচিতি পায়। এ অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করেছিলেন মো. বাকের আলী।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকাসহ সারা দেশে গণহত্যা শুরু করে। ওই রাতেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায়। এর আগেই বঙ্গবন্ধু ওই রাতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যতম নেতা এম আমীর-উল ইসলাম ফরিদপুর-কুষ্টিয়া হয়ে ৩০ মার্চ মেহেরপুর সীমান্তে আসেন। ৩১ মার্চের প্রথম প্রহরে তাঁরা দুজন সীমান্ত পার হয়ে ভারত চলে যান। পরে নানা ঘটনায় পর্যায়ক্রমিকভাবে তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের স্বীকৃতি ও সহায়তা চান। এর ধারাবাহিকতায় ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি করা হয়। আর প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ।
বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে আম্রকানন জড়িয়ে আছে নিবিড়ভাবে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর এক আম্রকাননেই প্রহসনের যুদ্ধে অস্তমিত হয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতার সূর্য। আবার দুই শতাধিক বছর পর মেহেরপুরের এক আম্রকাননেই উদিত হয়েছিল বীরত্বের গৌরব নিয়ে স্বাধীনতার সূর্য।
১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শপথ গ্রহণের ওই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটি ছিল খুব অনাড়ম্বর ও সংক্ষিপ্ত। প্রত্যক্ষদর্শী এবং এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা স্মৃতিচারণা করে বলেন, সকাল নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। আগের রাতে পাশের বিদ্যালয়, গির্জা ও ইপিআর ক্যাম্প থেকে বেঞ্চ এনে মঞ্চ করা হয়েছিল।
অনুষ্ঠানের প্রথমে ছিল পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। তারপর ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ এবং শপথ গ্রহণ। এ সময় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এরপর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের অর্ধশতাধিক সাংবাদিক এসেছিলেন এ অনুষ্ঠানে। তাঁদের কাছে পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সহায়তা কামনা করেন। বৈদ্যনাথতলাকে সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মুজিবনগর’ নামকরণের ঘোষণা দেওয়া হয়।
তা ছাড়া যে মেঠোপথ ধরে নেতারা ভারতের হৃদয়পুর এলাকা দিয়ে বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে এসেছিলেন, বাংলাদেশ অংশের সেই সড়কের নামকরণ করা হয় ‘স্বাধীনতা সড়ক’।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, স্বাধীনতা সড়কটুকু পাকা করা হয়েছে। শূন্যরেখার সামনে বিজিবির চেকপোস্ট। তারপর ভারত অংশের সড়কটি আগের মতোই মেঠোপথ রয়ে গেছে। শপথ গ্রহণ শেষে এ পথ দিয়েই তাঁরা ভারতে চলে যান।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করা ১৭ বছরের বাকের আলীর বাড়ি আম্রকানন থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে মুজিবনগর উপজেলার দারিয়াপুর ইউনিয়নের গৌরীনগর গ্রামে। গতকাল আমরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে আম্রকাননের স্মৃতিসৌধে নিয়ে আসি। যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে তিনি ৫২ বছর আগে কোরআন তিলাওয়াত করেছিলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে স্থানটি দেখিয়ে দিলেন। পরে আমগাছের তলায় বসে স্মৃতিচারণা করলেন।
বাকের আলীর বয়স এখন ৬৯ বছর। মুজিবনগর সরকারি ডিগ্রি কলেজের অর্থনীতি বিভাগ থেকে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে অবসরে গেছেন ২০১৩ সালে। তিনি বললেন, ‘আমি ১৯৭০ সালে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হই। ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল সকালে চুয়াডাঙ্গা থেকে বাড়ি রওনা দিই। যানবাহন ছিল না। প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ হেঁটে সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরি।’
বাকের আলী বলছিলেন, ‘গ্রামে ফিরেই শুনতে পেলাম, পরদিন বৈদ্যনাথতলায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটা অনুষ্ঠান হবে। আমি খুব সকালে উঠে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বৈদ্যনাথতলার দিকে যাই। পৌঁছাই সকাল আটটা নাগাদ। চারপাশে সিভিল পোশাক পরা অস্ত্রধারী অনেক লোক ছিল। তারা পুরো আমবাগান ঘিরে রেখেছিল। সেখানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ আরও অনেক নেতৃবৃন্দ ছিলেন। আমি সবাইকে চিনতাম না। একটু একটু করে আশপাশের এলাকা থেকে অনেক মানুষ আসছিলেন। পাশের চার্চ থাকে খ্রিষ্টান যাজকদেরও আসতে দেখলাম। তখন শুনলাম, এখানে কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ গ্রহণ হবে। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম যেখানে দুই শ বছরের পুরোনো মেহগনিগাছটি আছে, তার কাছেই একটা ছোট মঞ্চ করা হয়েছে। সেখানেই আমার সঙ্গে দেখা হলো দারিয়াপুর হাইস্কুলের শিক্ষক দোয়াজ উদ্দিনের সঙ্গে। আমি স্কুলে প্রথম হতাম এবং অধিকাংশ সময় অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতাম। দোয়াজ স্যার আমাকে দেখেই ডাক দিয়ে বললেন, ‘ভালোই হলো বাকের, তোমাকে পাওয়া গেল। আমাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান একটু পরেই শুরু হবে। তুমি কোরআন তিলাওয়াত করবে। কোথাও যেয়ো না। এখানেই থাকো।’
বাকের আলী বলছিলেন, ‘শপথ গ্রহণ আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। দোয়াজ স্যার ছিলেন এই কমিটির সভাপতি। স্যারের কথায় মঞ্চেই থেকে গেলাম। তবে খুব দ্রুতই অনুষ্ঠান শুরু হলো। এবং আমি সেখানে সুরা ফাতিহা পাঠ করলাম।’
বাকের আলীর মনে গভীর প্রশান্তি যে তিনি দেশের ইতিহাসের অংশ হতে পেরেছেন। পরে তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা আটকও করেছিল। কৌশলে ছাড়া পান। পরিবার নিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে তাঁর দুঃখ, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর নাম তালিকাভুক্ত হয়নি। তাঁর ওই অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের তথ্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বহু আকরগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে।
মেহেরপুর শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে এ আম্রকাননের অবস্থান। এটি ছিল জমিদার বৈদ্যনাথের আমবাগান। দেশ বিভাগের পর তাঁরা ভারতে চলে যান। তখন এই বাগান পরিত্যক্ত সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত হয়। আমগাছ ছিল প্রায় ২ হাজার ২৫০টি।
জেলার প্রবীণ বাসিন্দা ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্মৃতিসৌধের রক্ষণাবেক্ষণকারী সুভাষ মল্লিক জানালেন, যেখানে মঞ্চ করা হয়েছিল, সেই জায়গার পুরোনো আমগাছগুলো আর নেই। স্মৃতিসৌধ স্থাপনের সময় কাটা পড়েছে। কেবল ২০০ বছরের মেহগনিগাছটি আছে।
উদীয়মান সূর্য নামের মূল স্মৃতিসৌধটি করা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনাকে ঘিরে। মূল বেদি, যেখানে শপথ গ্রহণ মঞ্চ করা হয়েছিল, লাল রঙের সেই বেদির দৈর্ঘ্য ২৪ ফুট ও প্রস্থ ১৪ ফুট। মূল মঞ্চটিও এই মাপের ছিল।
এ বেদিকে ঘিরে উদীয়মান সূর্যের রশ্মি অর্ধবৃত্তাকারে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে রশ্মির প্রতীক প্রাচীর রয়েছে ২৩টি। এগুলো পাকিস্তানি ২৩ বছরে শোষণ এবং বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতীক। একেবারে পশ্চিমের রশ্মিটি ৯ ফুট ৯ ইঞ্চি। পরের রশ্মিগুলো প্রতিটি ৯ ইঞ্চি করে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ‘৯’ হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের প্রতীক।
স্থপতি তানভীর কবির এ স্থাপনার নকশা করেছেন। ১৯৮৭ সালে এ স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়।
পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ এলাকায় ‘মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। নতুন করে আরও ৪৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে বর্তমানে স্মৃতি কমপ্লেক্সের আয়তন দাঁড়িয়েছে ৯০ একর।
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের আম্রকাননে এখন বড় মনোরম দৃশ্য। সারি সারি আমগাছের শাখা ভরে উঠেছে সবুজ কচি আমে। নিচে গালিচার মতো সবুজ ঘাসের বিস্তার। তার মাঝে মাঝে শুভ্র উলুবন। তুষারের মতো সাদা ফুলে ভরা। শপথ গ্রহণের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানালেন, এমনই পরিবেশ ছিল ৫২ বছর আগেও। বাঙালির গৌরবের স্মৃতিধন্য এ মনোরম স্থান চিরকাল অন্যায়ের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে প্রেরণা জোগাবে।