বিদ্যুৎ খাতে ইনডেমনিটি আইন কেন

প্রথম আলো ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত: আগামীর ভাবনা’ শিরোনামে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে। সিপিডি পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি ইউনিট এই আয়োজনে সহযোগিতা করে।

শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় পার্টি

গত ১৫ বছরে সরকার অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পেরেছে, এটি অস্বীকার করা যাবে না। অন্যদিকে এর বিনিময়ে দেশ ও জাতিকে কী কী দিতে হচ্ছে, কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিসে এটি খুব একটা কার্যকর হচ্ছে কি না, তা–ও দেখতে হবে। বাংলাদেশে মোট তিনবার ইনডেমনিটি আইন করা হয়েছে। প্রথমবার বঙ্গবন্ধু হত্যার পর, দ্বিতীয়বার অপারেশন ক্লিন হার্ট বিষয়ে আর তৃতীয়বার বিদ্যুৎ খাতে ইনডেমনিটি আইন করা হয়েছে। আপনি একটা জিনিস উৎপাদন করবেন, এ জন্য ইনডেমনিটি আইন পাস করতে হবে কেন? এখনো সেই ইনডেমনিটি আইন কার্যকর রয়েছে। এ ধরনের আইন ও চুক্তি নিয়ে সংসদ ও মিডিয়াতে উন্মুক্ত আলোচনা হয়নি।

বিদ্যুৎ অর্থনীতির লাইফলাইন, এটা স্বীকার করতেই হবে। কুইক রেন্টাল (ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র) চালু করা হয়েছিল স্বল্প সময়ের জন্য। কিন্তু এখনো তা চলছে, স্থায়ী হয়ে গেছে। কেন স্থায়ী হলো? এর কারণ হচ্ছে সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক সুবিধাভোগী এসব লাইসেন্স নিয়েছেন। উৎপাদন বন্ধ রাখলেও তাঁরা টাকা পাচ্ছেন।

আমার ধারণা, বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল জনস্বার্থ, জনসমর্থন। শতভাগ বিদ্যুৎ দেব, মানুষ বিদ্যুৎ পাবে। একসময় বিদ্যুতের জন্য হাহাকার ছিল। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্যটি ভালো ছিল। ইনডেমনিটি দেওয়ার কারণে, সিন্ডিকেশন করার কারণে, স্বচ্ছতা না থাকার কারণে এখানে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার নেতিবাচক প্রভাব রাখতে শুরু করেছে।

আমরা শুনেছি, বর্তমানে ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ এখনো বাকি আছে। এ টাকা ডলারে পরিশোধ করতে হবে। কুইক রেন্টালসহ বিদ্যুৎ খাতে যেসব জ্বালানি নিয়ে আসা হচ্ছে, তার মূল্যও ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। আমাদের রিজার্ভ কমার এটাও তো একটা কারণ।

আমি মনে করি, এ সংকট থেকে বের হতে হলে এই মুহূর্তে আমাদেরকে কুইক রেন্টালগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। সংকটের এই সময়ে কিছুদিন দেশের মানুষকে ইলেকট্রিক রেশনিংয়ে অভ্যস্ত করতে হবে। এতে আমাদের ফুয়েল আমদানি কমে আসবে। আমাদের প্রচুর পরিমাণে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এটি কেবল বিদ্যুতের ক্ষেত্রে নয়, সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

নেপাল ও ভুটান থেকে কম টাকায় বিদ্যুৎ নিয়ে আসার কথা। যদিও এখানে সঞ্চালনের খরচ অনেক বেশি। এটি করা গেলে আমাদের এত ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হতো না। সরকারকে এখন একটা মাস্টারপ্ল্যান করতে হবে, যাতে অগ্রাধিকার নির্ধারিত থাকবে। কিছু জায়গায় ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে, কিছু পরিমাণ আমদানি করতে হবে, কিছু জায়গায় বিদ্যুৎ কম দামে দিতে হবে। উৎপাদন না হওয়াও ক্ষতি। বিদ্যুৎ ব্যবহার করে কার্যকর কিছু উৎপাদন করতে হবে, যা দেশের কাজে লাগবে। এগুলো অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ডলার আনবে। গার্মেন্টসে যেন অর্ডার বেশি থাকে, তাহলে বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি হবে। এতে করে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে না বা কম দিতে হবে। অন্যথায় শুধু ক্যাপাসিটিটি চার্জ দিয়েই যাবে, এমনটি হলে সরকার কোনোভাবেই অর্থনীতির ধাক্কা সামলাতে পারবে না।

জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বলতে চাই, আমরা কোনোভাবেই এ ধরনের ইনডেমনিটি আইন রাখতে চাই না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে আমরা উন্মুক্ত, জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ ও পরিষ্কার রাখতে চাই। নবায়নযোগ্য শক্তিকে অনেক গুরুত্ব দিতে চাই। কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস করে আমরা যদি দেখি অন্য দেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করলে আমাদের উৎপাদনের তুলনায় খরচ কম হবে, তাহলে আমরা তাকে গুরুত্ব দেব। সঞ্চালন লাইন ও পরিচালনায়ও আমাদের নজর থাকবে।

তৃণমূল পর্যায়ে বিদ্যুৎ আছে, কিন্তু বিদ্যুৎসেবা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত লোকবল নেই। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে দ্রুতই তার সমাধান করার মতো পর্যাপ্ত লোকবল সেখানে নেই। আমি মনে করি, এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ খাতে আউটসোর্সিং হোক আর যেভাবেই হোক। অন্তত এক লাখ লোক সেবা দেওয়ার জন্য নিয়োগ দেওয়া উচিত।

বিদ্যুতের বিল নিয়ে অনেক হয়রানির অভিযোগ আছে। আমরা যেকোনো মূল্যে এটি বন্ধ করব। কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থায় এই কাজগুলো করা হবে। ফলে সেখানে টেম্পারিংয়ের কোনো সুযোগ থাকবে না, কাউকে হয়রানি করা হবে না। এ দেশের মানুষ সেবা পাবে, শান্তিতে বিদ্যুৎ উপভোগ করবে—এ নিশ্চয়তা জাতীয় পার্টি দেবে।

(সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ৩১ অক্টোবর ২০২৩)