পবিত্র ঈদুল আজহার আগে প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি খবরে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। ‘এবার ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি’ শিরোনামে ৭ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে আনা ১ হাজার ৭৫০ কেজি ওজনের (বিক্রেতার দাবি) একটি গরুর দামের উদাহরণ উল্লেখ করা হয়। বিক্রেতা গরুটির দাম চাইছিলেন ৩০ লাখ টাকা। সেদিন পর্যন্ত দাম উঠেছিল ১৯ লাখ টাকা।
আসুন একটু অঙ্ক কষি। ১৯ লাখ টাকা দাম হলে জীবন্ত অবস্থায় গরুটির প্রতি কেজির দাম দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার ৮৬ টাকা। আর শুধু মাংসের দাম পড়ে প্রতি কেজি ১ হাজার ৮০০ টাকার মতো (ওজনের ৬০ শতাংশ মাংস ধরে)। বিক্রেতা ১৯ লাখ টাকা দাম ওঠার পরও গরুটি বিক্রি করেননি। অপেক্ষায় ছিলেন আরও বেশি দামের।
এমন আরও উদাহরণ দেওয়া যায়। বড় বড় গরুর আকৃতি অনুসারে বিক্রেতা যে দাম চেয়েছেন, তাতে প্রতি কেজি মাংসের দাম পড়ে দেড় হাজার টাকার বেশি। পরিচিতজনদের কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এবার পবিত্র ঈদুল আজহায় গরু কেনার ব্যয় বিবেচনায় প্রতি কেজি মাংসের দাম এক হাজার টাকার আশপাশে পড়েছে।
ঢাকার বাজারে এখন গরুর মাংসের দাম প্রতি কেজি ৭০০ টাকা। এক বছর ধরেই দামটি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে রয়েছে। এক বছর আগেও এ দাম ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকা ছিল। একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ২০১৪ সালে গরুর মাংসের গড় দাম ছিল প্রতি কেজি ২৭৫ টাকা (কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য)। এর পর থেকে দাম বাড়ছেই। ওদিকে আমরা প্রতিবছরই শুনছি, গরুর সংখ্যা বাড়ছে, মাংসের উৎপাদন বাড়ছে।
হ্যাঁ, গরুর সংখ্যা ও মাংসের উৎপাদন বাড়ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মাংস সীমিত আয়ের মানুষের নাগালছাড়া হয়ে গেছে। এখন এক কেজি গরুর মাংসের দাম রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার নিম্নতম মজুরিতে কাজ করা একজন শ্রমিকের ২ দশমিক ৬ দিনের বেতনের সমান। তাই শ্রমিকের পাতে এখন গরুর মাংস ওঠা কঠিন। আমার জানা সীমিত আয়ের দু-একটি পরিবারে আগে মাসে দু-একবার গরুর মাংস কেনা হতো। এখন তারা তা বাদ দিয়েছে, বাধ্য হয়েছে।
শুধু সীমিত আয়ের পরিবার নয়, গরুর মাংস ব্যয় বাড়িয়েছে বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠানের। রেস্তোরাঁগুলোয় গরুর মাংসে তৈরি খাবারের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে, যা তাদের ক্রেতা কমিয়েছে।
এবার পবিত্র ঈদুল আজহায় দেখা গেল, গরুর দাম অস্বাভাবিক রকমের বেশি। আমার চেনাজানা কেউ কেউ এবার কোরবানি দিতে পারেননি। কেউ কেউ দিয়েছেন, তবে ভাগ কমিয়ে।
বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে ভারত থেকে গরু আসা কার্যত বন্ধ হওয়ার পর। ভারতে নরেন্দ্র মোদি সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৫ সালের এপ্রিলে দেশটির তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সে দেশের সীমান্তরক্ষীদের উদ্দেশে বাংলাদেশে গরু ঢোকা পুরোপুরি বন্ধ করতে নির্দেশনা দেন। এরপর এক বছরেই দেশে গরুর মাংসের গড় দাম কেজিপ্রতি ৬৯ টাকা বেড়ে ৩৪৪ টাকায় দাঁড়ায়।
ভারতীয় গরুর সরবরাহ বন্ধের পর সরকারের উদ্যোগটি ভালো ছিল। সরকার দেশে গরু লালন-পালন বাড়াতে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া শুরু করে। গোখাদ্যের দাম কমাতে উপকরণ আমদানির শুল্ককর কমানো হয়। দেশের তরুণ উদ্যোক্তা ও সাধারণ খামারিরা গরু পালন বাড়াতে শুরু করেন। নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। গত কয়েক বছরে কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানও গবাদিপশু খাতে নতুন বিনিয়োগে আসে। কারণ, ভারত থেকে সরবরাহ বন্ধ ও বাড়তি দাম মুনাফার সুযোগ তৈরি করে।
প্রশ্ন হলো, এ মুনাফা কিসের বিনিময়ে? বিনিময় হয়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও গরুর মাংস খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। গত ৮ এপ্রিল ‘গরুর মাংসের কেজি ৭০০ টাকা কেন, কোন যুক্তিতে’ শিরোনামে প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত একটি লেখায় দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান, ইউরোপের যুক্তরাজ্য এবং আমেরিকার চেয়ে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম অনেকটাই বেশি। অথচ ওই সব দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষ বহু পেছনে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো (বিবিএস) গত মাসে কৃষিশুমারির প্রাথমিক ফলাফলে জানিয়েছে, দেশে গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখের কিছু বেশি। ২০০৮ সালের তুলনায় গরুর সংখ্যা বেড়েছে ৪০ লাখের মতো।
দেশে গরুর সংখ্যা আসলে বেড়েছে কি না, যতটা বেড়েছে, ততটা প্রয়োজনের তুলনায় কতটুকু, সে বিতর্ক করে লাভ নেই। কারণ, সরকারি সংস্থা ছাড়া উৎপাদনের আর কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে কোন পণ্যের সরবরাহ কত, তা বাজারের আচরণ দেখে বোঝা যায়। আমরা বছর বছর গরুর মাংসের উৎপাদন বাড়ার হিসাব দিচ্ছি, কিছু মাংস দিন দিন মানুষের নাগালের বাইরে যাচ্ছে। বিপরীতে আমরা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা মাছ তেলাপিয়া, পাঙাশ ও কইয়ের দামের চিত্রটি দেখতে পারি। বহু বছর ধরে এসব মাছের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে আছে। সারা বছর তা মোটামুটি একই থাকে।
এবারের পবিত্র ঈদুল আজহার আগে বরাবরের মতো প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলো, দেশীয় গবাদিপশু দিয়েই চাহিদা মিটবে। প্রশ্ন হলো, এ চাহিদার হিসাব কিসের ভিত্তিতে তৈরি। মাংসের কেজি যদি ৩০০ টাকা হতো, তাহলে কি পশু কোরবানি বেশি হতো, আরও বেশি পশুর প্রয়োজন হতো?
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে মাঝারি আকারের রুই মাছের জাতীয় গড় খুচরা দাম ছিল প্রতি কেজি ৩০৩ টাকা। ২০২০ সালে তা দাঁড়ায় ৩২০ টাকায়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতির তুলনায় রুই মাছের দাম বেড়েছে কম হারে। এখনো বাজারে মাঝারি আকারের রুই মাছ প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যায়।
মুরগির দামের চিত্রটিও দেখা যাক। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, ২০১০ সালে দেশে ফার্মের মুরগির জাতীয় গড় দাম ছিল প্রতি কেজি ২২৭ টাকা। ২০১৪ সালে সেটি কমে ১৩৭ টাকায় নামে। ২০২০ সালে এই গড় দাম ছিল ১২৫ টাকা। ঢাকার বাজারে এখন ফার্মের ব্রয়লার মুরগির প্রতি কেজির দাম ১৪০ টাকার আশপাশে।
সুতরাং বাজার বলছে, উৎপাদন বেশি হলে দাম নাগালে থাকে। চাষের মাছ ও খামারের মুরগির দাম সীমিত আয়ের মানুষের নাগালেই আছে। মোটাদাগে বলা যায়, খামারিরা আয় করতে পারছেন বলেই মাছ চাষ করছেন, মুরগি পালন করছেন।
এবারের পবিত্র ঈদুল আজহার আগে বরাবরের মতো প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলো, দেশীয় গবাদিপশু দিয়েই চাহিদা মিটবে। প্রশ্ন হলো, এ চাহিদার হিসাব কিসের ভিত্তিতে তৈরি। মাংসের কেজি যদি ৩০০ টাকা হতো, তাহলে কি পশু কোরবানি বেশি হতো, আরও বেশি পশুর প্রয়োজন হতো?
স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার দুটি উপায় আছে। প্রথমত, চাহিদার বেশি উৎপাদন। দ্বিতীয়ত, দাম এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যাতে চাহিদা কমে উৎপাদনক্ষমতার কাছাকাছি পর্যায়ে চলে আসে। আমরা বোধ হয় দ্বিতীয় উপায়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। নইলে গরুর এত দাম হবে কেন?
চাহিদা বেশি থাকায় উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়বে, বাণিজ্যিক খামারিরা উৎপাদনের ব্যয় কমানোর উপায় খুঁজে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে ঝুঁকবেন। মানুষ যদি দামে কুলাতে না পেরে মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়, তাহলে নতুন বিনিয়োগকারীরা কী করবেন?
মাংসের দাম এত বেশি হওয়ার আরেকটি কারণ, দেশীয় উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের কোনো প্রতিযোগী নেই। বাংলাদেশে মাংস আমদানি কার্যত নিষিদ্ধ। আমদানি করতে হলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আগাম অনুমোদন নিতে হয়। কোনোরকমে অনুমতি পাওয়ার পর আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি কেজিতে শুল্ককর দিতে হয় প্রায় ৫৯ শতাংশ। মানে হলো, ১০০ টাকায় এক কেজি মাংস আমদানি করলে ৫৯ টাকা দিতে হবে শুল্ককর। এত ঝক্কির মধ্যে মাংস আমদানি হয় না।
সরকারের এই নীতি এসেছে গবাদিপশু পালনে নতুন বিনিয়োগকারীদের চাপে। এই বিনিয়োগকারীরা গ্রামের সাধারণ কৃষক নন, তাঁরা প্রভাবশালী। যেহেতু কোনো প্রতিযোগী নেই, সেহেতু গরুর হাটে প্রতি কেজি ১ হাজার ৮০০ টাকা দাম ওঠার পরও বিক্রেতা গরু বিক্রি করেন না, আরও বাড়তি দাম আদায়ের সুযোগ খোঁজেন।
দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সরকার নানা ধরনের নীতি নেয়। সেটা ঠিকই আছে। গরুর খামারিদের সেই সুরক্ষা দিতে হবে। তবে সে ক্ষেত্রে দেখতে হয় ভোক্তার স্বার্থও। দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা কত বছর দেওয়া হবে ও কতটা দেওয়া হবে, তা-ও বিবেচনায় নিতে হয়। নইলে অত্যধিক সুরক্ষা অত্যধিক মুনাফার সুযোগ করে দেয়। বিনিয়োগকারীরা সুরক্ষিত বাজারে উদ্ভাবন, উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে নজর দেন না।
এ জন্যই ‘ইফেক্টিভ রেট অব প্রটেকশন’ কত হওয়া উচিত, সেটা বিবেচনা করা হয়। আমার বিবেচনায়, বাংলাদেশে গরুর মাংসের কেজি হওয়া উচিত ৫০০ টাকার আশপাশে। এটা হলে গরুর মাংসের চাহিদা বাড়বে। চাহিদা বেশি থাকায় উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়বে, বাণিজ্যিক খামারিরা উৎপাদনের ব্যয় কমানোর উপায় খুঁজে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে ঝুঁকবেন। মানুষ যদি দামে কুলাতে না পেরে মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়, তাহলে নতুন বিনিয়োগকারীরা কী করবেন?
দেশে গরুর মাংসের উৎপাদন খরচ কত, সেটা কত হওয়া উচিত, কত টাকা বাজারদর হলে উৎপাদক ও ভোক্তার জন্য সুবিধাজনক, তা নিয়ে একটি সমীক্ষা করা দরকার। ধরা যাক, সমীক্ষায় এল ৫০০ টাকা কেজি হলে সেটা সবার জন্য লাভজনক হয়, তা হলে সে অনুযায়ী শুল্ককর নির্ধারণ করে আমদানি উন্মুক্ত করা দরকার।
এবারের পবিত্র ঈদুল আজহায় প্রচুর গরু কোরবানি হয়েছে। আগামী দিনগুলোয় গরুর মাংসের দাম আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা। সেখানে লাগাম টানতেই হবে। এ জন্য যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মনে রাখা দরকার, সরকারি উদ্যোগে ৫০০ টাকায় এক কেজি গরুর মাংস বিক্রির ট্রাকের পেছনে মানুষের লাইন দেশের জন্য লজ্জাজনক। সেটা দাম কমানোর কোনো সমাধানও নয়। দামের লাগাম টানতে না পারলে এটাও বলে দেওয়া যেতে পারে, গরুর মাংস কোনো নিত্যপণ্য নয়। এটার দাম কত হলো, সেটা নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই। মানুষ কিনতে পারলে গরুর মাংস খাবে, নইলে নয়।