অধিকাংশ মেয়র-চেয়ারম্যান আত্মগোপনে

প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ১২৯ কাউন্সিলরের মধ্যে আত্মগোপনে আছেন ১১৮ জন।

স্থানীয় সরকারের সব স্তরেই আওয়ামী লীগ তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রায় সব শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দখলে। গণ-আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর স্থানীয় সরকারের এই জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে গেছেন। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৪টির মধ্যে ৪৪টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানই বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন। ৪৯৫টি উপজেলা পরিষদের ৩১৯টিতেই উপজেলা চেয়ারম্যানরা গা ঢাকা দিয়েছেন। আর ৩৩০টির মধ্যে ২০৫টি পৌরসভার মেয়র আত্মগোপনে আছেন। এ ছাড়া অনেক জনপ্রতিনিধি এলাকায় থাকলেও কার্যালয়ে যাচ্ছেন না। তবে আওয়ামী লীগের বাইরে বিএনপিসহ অন্য দলের যেসব জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, তাঁরা নিয়মিত কার্যালয়ে যাচ্ছেন, দাপ্তরিক কাজ করছেন।

দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে ৯টির মেয়র আত্মগোপনে রয়েছেন। রংপুরের মেয়র জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান, গাজীপুরের মেয়র জায়েদা খাতুন এবং নারায়ণগঞ্জের সেলিনা হায়াৎ আইভী নিয়মিত কার্যালয়ে যাচ্ছেন।

প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ১২৯ কাউন্সিলরের মধ্যে আত্মগোপনে আছেন ১১৮ জন।

আগে সব ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হতো। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালের আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ার পর বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন করে। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপুল সংখ্যায় সরকারদলীয় প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি কর্মস্থলে আসছেন না। তাঁদের অনুপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম প্রধান নির্বাহী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী প্রকৌশলীরা অফিস চালাচ্ছেন। তবে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা আত্মগোপনে থাকা জনপ্রতিনিধিদের কাছে থাকায় নিয়মিত কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।

দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে ৯টির মেয়র আত্মগোপনে রয়েছেন। রংপুরের মেয়র জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান, গাজীপুরের মেয়র জায়েদা খাতুন এবং নারায়ণগঞ্জের সেলিনা হায়াৎ আইভী নিয়মিত কার্যালয়ে যাচ্ছেন।

পুরো জেলা জনপ্রতিনিধিশূন্য

১০ দিন ধরে বাগেরহাট জেলার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রতিনিধিশূন্য হয়ে পড়েছে। বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ কামরুজ্জামান টুকু আত্মগোপনে রয়েছেন। জেলার ৯টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানই আওয়ামী লীগদলীয় এবং তাঁরা আত্মগোপনে আছেন। বাগেরহাট সদর, মোরেলগঞ্জ ও মোংলা পোর্ট—বাগেরহাটের তিনটি পৌরসভার মেয়রও আত্মগোপনে রয়েছেন।

শরীয়তপুরের জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পাঁচজন উপজেলা চেয়ারম্যান ও পাঁচজন পৌরসভার মেয়র আত্মগোপনে আছেন। মুন্সিগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মহিউদ্দিন ও ছয়টি উপজেলা পরিষদের সব কটির চেয়ারম্যান আত্মগোপনে রয়েছেন।

সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম আত্মগোপনে রয়েছেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও প্রধান নির্বাহী অফিসের চিঠিপত্র আদান-প্রদান করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করছেন না। সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ছয়টির চেয়ারম্যান আত্মগোপনে। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। কলারোয়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামও আত্মগোপনে।

৬৭ জনের মধ্যে ৫৫ জনই আত্মগোপনে

রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মধ্যে রাজশাহী, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আত্মগোপনে আছেন। জয়পুরহাট ও নাটোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অসুস্থ হয়ে বাড়িতেই থাকেন। শুধু নওগাঁ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অফিস করছেন।

রাজশাহী বিভাগের ৬৭টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ৫৫টির চেয়ারম্যান আত্মগোপনে আছেন। অফিস করছেন মাত্র ৯ জন। বাকি তিনজন এলাকায় থাকলেও অফিস করেন না। আর এই বিভাগের ৬১টি পৌরসভার মধ্যে ৪২টি পৌরসভার মেয়র গা-ঢাকা দিয়ে আছেন।

কুমিল্লা সিটি মেয়র তাহসীন বাহার আত্মগোপনে আছেন। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছামছুল আলম জানান, তিনি সিটি করপোরেশনে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন। সিটি করপোরেশনের কয়েকজন কাউন্সিলর দেখা করে গেছেন। প্রতিটি বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হচ্ছে।

তবে সারা দেশের ব্যতিক্রম চিত্র গোপালগঞ্জে। গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান মুন্সি এলাকায় আছেন এবং অফিস করছেন। পাঁচ উপজেলা চেয়ারম্যানই উপজেলায় আছেন এবং কাজ করছেন। চারজন পৌর মেয়রও এলাকায় আছেন।

এ ছাড়া সাভার পৌরসভার মেয়র মো. আব্দুল গণি, ধামরাই পৌরসভার মেয়র গোলাম কবির ও দোহার পৌরসভার মেয়র আলমাছ উদ্দিন আত্মগোপনে আছেন। পৌরসভার কর্মকর্তারা জানান, যেসব নথিপত্রে মেয়রের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়, সেগুলোর কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিনই জন্মনিবন্ধন, নাগরিক সনদ ও নানা কাজে এসে ফিরে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

ঢাকা ও রংপুরেও একই চিত্র

ঢাকার পাঁচটি উপজেলা পরিষদের মধ্যে চারটির চেয়ারম্যান ৫ আগস্ট থেকে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম, কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীন আহমেদ, দোহার উপজেলা চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন এবং নবাবগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ আত্মগোপনে রয়েছেন।

এ ছাড়া সাভার পৌরসভার মেয়র মো. আব্দুল গণি, ধামরাই পৌরসভার মেয়র গোলাম কবির ও দোহার পৌরসভার মেয়র আলমাছ উদ্দিন আত্মগোপনে আছেন। পৌরসভার কর্মকর্তারা জানান, যেসব নথিপত্রে মেয়রের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়, সেগুলোর কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিনই জন্মনিবন্ধন, নাগরিক সনদ ও নানা কাজে এসে ফিরে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

রংপুর বিভাগের আট জেলার মধ্যে ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আত্মগোপনে। রংপুর ও গাইবান্ধা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এলাকায় থাকলেও অফিস করছেন না। লালমনিরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চিকিৎসার কাজে ভারতে গিয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।

রংপুর বিভাগের ৫৮টি উপজেলার মধ্যে ২৮ জন আত্মগোপনে আছেন। ২৯ জন এলাকায় থাকলেও তাঁদের মধ্যে মাত্র ১২ জন অফিস করছেন। বাকি একটি উপজেলা চেয়ারম্যানের শপথ স্থগিত আছে। এই বিভাগের ৩১টি পৌরসভার মধ্যে ১৫টির মেয়র আত্মগোপনে আছেন। বাকি ১৬ জন এলাকায় থাকলেও তাঁদের মধ্যে ৯ জন অফিস করছেন।

আত্মগোপনে থাকা জনপ্রতিনিধিরা যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন না বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় মনোনয়ন যাঁরা পেয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই দুর্বৃত্ত। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁরা দায়িত্বে আসেননি। মনোনয়ন-বাণিজ্য, পেশিশক্তি, কালোটাকা ও প্রশাসনিক সহায়তায় তাঁরা নির্বাচনে জিতেছিলেন। তাই জনরোষের ভয়ে এখন পালিয়ে আছেন। তাঁরা ফিরে না এলে অন্তর্বর্তী সরকারকে সাময়িক কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোনিজস্ব প্রতিবেদকপ্রতিনিধিরা)৬৭ জনের মধ্যে ৫৫ জনই আত্মগোপনে