টুনা মাছ নিয়ে কয়েক মাস গবেষণার পর ২১ কোটির জাহাজ দুটির কী হবে

গভীর সমুদ্রের কোন অংশে কী পরিমাণ টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ রয়েছে, তা নিয়ে গবেষণার জন্য প্রায় সোয়া ২১ কোটি টাকায় দুটি জাহাজ কিনছে মৎস্য অধিদপ্তর। তবে গবেষণা শেষে জাহাজ দুটির কী হবে, সে ব্যাপারে খোদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই কিছু বলতে পারছেন না। আর গবেষণার মেয়াদও হবে মাত্র কয়েক মাস। তাই এ গবেষণা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।

গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণ নামের পাইলট প্রকল্পের আওতায় জাহাজ দুটি কেনা হচ্ছে। এতে খরচ হবে ১৯ লাখ ২৪ হাজার ডলার বা ২১ কোটি ১৬ লাখ টাকা (এক ডলার সমান ১১০ টাকা ধরে)। জাহাজ দুটি হবে লং লাইনার ধরনের, যা দিয়ে গভীর সমুদ্রে (আন্তর্জাতিক জলসীমায়) মাছ ধরা যায়।

প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর জানায়, এ গবেষণায় সহযোগিতা করার জন্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং জাপানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা রাজি হয়নি। মৎস্য অধিদপ্তরের যে জাহাজ আছে, সেটি দিয়েও গবেষণা করা সম্ভব নয়। গভীর সমুদ্রে গবেষণার জন্য দেশে এ ধরনের কোনো জাহাজ নেই। তাই বাধ্য হয়ে জাহাজ দুটি কিনতে হচ্ছে।

প্রতিবছর অক্টোবরে শুরু হয় টুনা মাছের মৌসুম। প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে দেশে এলে আগামী অক্টোবর থেকে গবেষণার কাজ শুরু হবে। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের জুনে। এর আগেই গবেষণার কাজ গুটিয়ে নিতে হবে। ফলে এ গবেষণার জন্য কেনা জাহাজ দুটি ব্যবহৃত হবে মাত্র সাত থেকে আট মাস। এরপর এগুলোর কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ, মৎস্য অধিদপ্তর বাণিজ্যিকভাবে মাছ ধরে না।

এত অল্প সময়ে লামসাম করে একটা কিছু করা হয়তো সম্ভব হবে। বাস্তবতা অনেক দূর। টুনা মাছের মৌসুম ও তার জীবনচক্র এবং সমুদ্রের জীবনচক্র—এসব সম্পন্ন করতে হবে।
মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন, অধ্যাপক, সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

গবেষণা শেষে জাহাজ দুটির কী হবে, এমন প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক মো. জুবায়দুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনকেও (বিএফডিসি) দিতে পারে, মৎস্য অধিদপ্তরও রাখতে পারে। এটা বলা যায় না।

প্রতিটি প্রকল্পের ‘বহির্গমনের পথ’ (এক্সিট প্ল্যান) থাকে। সে অনুযায়ী প্রকল্প শেষে জাহাজ দুটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালকের জানা থাকা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় এ রকম নানা কেনাকাটা হয়, প্রকল্প শেষে সেসবের খোঁজ থাকে না।

কখনো কখনো পড়ে থেকে সেগুলো নষ্ট হয়। এতে অর্থের অপচয় হয়।

মৎস্য অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণা শেষে জাহাজ দুটি অধিদপ্তর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিতে পারে। না হলে দেখা যাবে পড়ে থেকে জাহাজ নষ্ট হচ্ছে।

জাহাজ দুটি কবে আসবে, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। জাহাজ না আসা পর্যন্ত প্রকল্পের তেমন কোনো কাজও হয়নি। প্রকল্প দপ্তর জানিয়েছে, এখনো জাহাজ দুটি সরবরাহের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাহাজ দেখতে চীনে যাবেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। আগামী মে মাসের আগে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। জাহাজ পেলে আগামী অক্টোবরে (টুনা ধরার মৌসুম শুরু) গবেষণার জন্য গভীর সাগরে যাবেন তাঁরা।

মাছ না ধরলেও দিতে হচ্ছে টাকা

আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরতে লং লাইনার ও পার্সসেইনার ধরনের জাহাজের প্রয়োজন হয়। এ ধরনের জাহাজ বাংলাদেশে নেই। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের লক্ষ্যে টুনা ও টুনা জাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণে সক্ষম নৌযান নির্মাণ বা আমদানির অগ্রগতিবিষয়ক পর্যালোচনা সভা হয়।

ওই সভা সূত্র জানায়, গভীর সমুদ্রে বা আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরার জন্য ১৯টি লং লাইনার ও পার্সসেইনার ধরনের জাহাজ কেনার অনুমতি দিয়েছিল মৎস্য অধিদপ্তর। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ এ ধরনের জাহাজ কেনেনি।

২০১৮ সালে ইন্ডিয়ান ওশান টুনা কমিশনের (আইওটিসি) সদস্যপদ পেয়েছে বাংলাদেশ। আইওটিসির সদস্য হওয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জলসীমায় (বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায়) মাছ ধরার অধিকার পেয়েছে। তবে আইওটিসির সদস্যদেশ হিসেবে সংস্থাটিকে প্রতিবছর ৭০ হাজার মার্কিন ডলার (৭৭ লাখ টাকা) দিতে হয় বাংলাদেশকে।

প্রকল্প দপ্তর জানিয়েছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আইওটিসির সদস্যপদ লাভ করলেও এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরেনি।

আইওটিসির সদস্যপদ পাওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় কোন দেশ কত মাছ ধরছে, কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে—এ ধরনের তথ্য পেয়ে থাকে বাংলাদেশ। সরাসরি সদস্যপদ না নিয়ে পর্যবেক্ষক দেশ হিসেবে থেকেও এসব তথ্য পেতে পারত বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, আইওটিসির সদস্যপদ মৎস্য অধিদপ্তর হুট করে নিয়ে নিল। কোনো ধরনের প্রস্তুতি না থাকায় এখন মাছ ধরা ছাড়াই টাকা দিতে হচ্ছে। কিছু কর্মকর্তার বিদেশ সফর ও মৎস্য অধিদপ্তর বাহবা কুড়ানোর জন্য এসব করেছে বলেও অভিযোগ তাঁর।

‘গবেষণায় নেমে বোঝা যাবে’

২০২০ সালের জুলাইয়ে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল গত বছরের ডিসেম্বরে। তবে এর মেয়াদ দেড় বছর বাড়িয়ে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। আর ব্যয় কমানো হয়েছে ৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

এ প্রকল্পের আওতায় গভীর ও আন্তর্জাতিক জলসীমায় কী পরিমাণ টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আছে এবং বাংলাদেশের মৎস্য ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় মাছ ধরতে পারবেন, সে বিষয়ে গবেষণায় ব্যবহৃত হবে জাহাজ দুটি। যাতে বেসরকারি ব্যবসায়ীরা জাহাজ কিনে গভীর সাগরে বা আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরতে উদ্বুদ্ধ হন।

প্রতিবছর অক্টোবরে শুরু হয় টুনা মাছের মৌসুম। প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে দেশে এলে আগামী অক্টোবর থেকে গবেষণার কাজ শুরু হবে। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের জুনে। এর আগেই গবেষণার কাজ গুটিয়ে নিতে হবে। ফলে এ গবেষণার জন্য কেনা জাহাজ দুটি ব্যবহৃত হবে মাত্র সাত থেকে আট মাস। এরপর এগুলোর কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ, মৎস্য অধিদপ্তর বাণিজ্যিকভাবে মাছ ধরে না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্প যথাসময়ে শেষ না হওয়ার অন্যতম কারণ ডলার–সংকটের কারণে জাহাজ কিনতে না পারা। প্রথমে তিনটি জাহাজ কেনার কথা ছিল। তবে এখন ডলারের দাম বাড়ায় খরচ বেড়েছে। ফলে তিনটির বদলে দুটি জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অধিদপ্তর। ৩টি জাহাজ কেনার কথা ছিল ২৮ লাখ ৮৬ হাজার ডলারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাহাজ দুটি সরবরাহ করছে সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠান। চীনের আরেকটি প্রতিষ্ঠান জাহাজ তৈরি করছে। মাঝপথে একটি জাহাজের কার্যাদেশ বাতিল করলেও কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে না বলে দাবি করেছে প্রকল্প দপ্তর।

একটি জাহাজ কম নিয়ে গবেষণা করতে যাচ্ছেন, এর নেতিবাচক প্রভাব গবেষণায় পড়বে কি না—এমন প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক জুবায়দুল আলম বলেন, গবেষণায় নেমে বোঝা যাবে।

জাহাজ দুটি কবে আসবে, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। জাহাজ না আসা পর্যন্ত প্রকল্পের তেমন কোনো কাজও হয়নি। প্রকল্প দপ্তর জানিয়েছে, এখনো জাহাজ দুটি সরবরাহের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাহাজ দেখতে চীনে যাবেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। আগামী মে মাসের আগে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। জাহাজ পেলে আগামী অক্টোবরে (টুনা ধরার মৌসুম শুরু) গবেষণার জন্য গভীর সাগরে যাবেন তাঁরা।

এদিকে জাহাজ বুঝে পাওয়ার আগেই তিন জাহাজের জন্য তিনটি ডিজিটাল ক্যামেরা কেনা হয়েছে প্রকল্পের টাকায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১১ লাখ টাকায় ক্যামেরা তিনটি কেনা হয়েছে। একটি জাহাজ কম কেনার সিদ্ধান্ত হওয়ায় এখন একটি ক্যামেরা অব্যবহৃত থাকবে।

তবে প্রকল্প দপ্তর দাবি করছে, মৎস্য অধিদপ্তরের ‘আরভি মীন সন্ধানী’ নামের একটি জাহাজে সেই ক্যামেরা ব্যবহার করা হবে। তবে এর ব্যবহার আদৌ কতটা যৌক্তিক হবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সংশয় রয়েছে।

দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার পরামর্শ

অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশের জলসীমার ২০ শতাংশ উপকূলীয়, ৩৫ ভাগ অগভীর সাগর ও ৪৫ ভাগ গভীর সাগর। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশের জলসীমা। এর পর থেকে আন্তর্জাতিক জলসীমা শুরু, যাকে গভীর সাগর হিসেবেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের জাহাজগুলো আন্তর্জাতিক জলসীমায় গিয়ে মাছ ধরে না।

মৎস্য অধিদপ্তরের কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা জানান, মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বা বিশ্ববিদ্যালয়—কোথাও টুনা বা সমজাতীয় পেলাজিক মাছের ঐতিহাসিক, জৈবিক, প্রজনন ও চলাচলের (মাইগ্রেটরি) তথ্য-উপাত্ত নেই। এ নিয়ে গবেষণা নেই। কোনোরকমের তথ্য-উপাত্ত ছাড়া হুট করে জাহাজ কিনে অল্প কয়েক মাস গবেষণা চালিয়ে ফলপ্রসূ হওয়া কঠিন হবে বলে মনে করেন তাঁরা।

এত স্বল্পমেয়াদি গবেষণা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত অল্প সময়ে লামসাম করে একটা কিছু করা হয়তো সম্ভব হবে। বাস্তবতা অনেক দূর। টুনা মাছের মৌসুম ও তার জীবনচক্র এবং সমুদ্রের জীবনচক্র—এসব সম্পন্ন করতে হবে।’

কয়েক মাসের গবেষণায় কীভাবে তা সম্ভব, এমন প্রশ্ন তুলে অধ্যাপক মোসলেম উদ্দিন আরও বলেন, বিষয়টি ফলপ্রসূ করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা করতে হবে। এ গবেষণায় সমুদ্র গবেষকদের যুক্ত করার আহ্বান জানান তিনি।