কলসিন্দুর যে রাজধানী থেকে অনেক দূরে, জানতাম। কিন্তু কত দূর, এবার হাড়ে–হাড়ে এবং কোমরে-হাঁটুতে বোঝা হলো। ১ অক্টোবর ভোর পাঁচটায় একটা মাইক্রোবাস নিয়ে আমরা ঢাকা ছেড়েছি।
আমাদের দলে আছেন ক্রীড়া সাংবাদিক বদিউজ্জামান, আলোকচিত্রী খালেদ সরকার, ভিডিও দলের জাকারিয়া মৃধা এবং এস এস আল আরেফিন, অনুষ্ঠান বিভাগের শুভাশীষ প্রামানিক। অতিথি সফরসঙ্গী মেরিনা এবং নবীন প্রজন্মের সৃজন সৈকত।
ময়মনসিংহে নাশতা সারা হলো। প্রথম আলোর প্রতিনিধি কামরান পারভেজকে তুলে নেওয়া হলো গাড়িতে। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল কিশোর আলোর নবম জন্মবার্ষিকীর বিশাল এক কেক নেওয়া।
এরপর মাত্র ৫১ কিলোমিটার। সেই রাস্তায় যাচ্ছি, দুধারে ধানের খেতে সবুজের বিস্তার, আর পথে পথে ইজিবাইক। মাঝেমধ্যেই রাস্তা খারাপ। কামরান পারভেজ জানালেন, আগে তো এ রাস্তাও ছিল না। এখন তো অনেক ভালো। এই ভালো রাস্তা গাড়িতে পেরোতে আবিষ্কার করলাম, কোমর বলতে একটা অঙ্গ আমাদের আছে; আর তার সইবার একটা সীমা আছে। দুই ঘণ্টা যেন অনন্তকাল। লংগেস্ট ফিফটি মাইলস।
ধোবাউড়া উপজেলা সদর পেরিয়ে কলসিন্দুরের আধা ভাঙা রাস্তা চলতে গিয়ে আমরা প্রথমে বাঁয়ে পেলাম দুটো উজ্জ্বল নীল রঙের ইটের দেয়ালঘেরা টিনে ছাওয়া ঘর। সানজিদাদের বাড়ি।
সানজিদা এরই মধ্যে দেশজোড়া এক পরিচিত নাম। সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন নারী দলের সদস্য। ফাইনালের আগে তাঁর একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি লিখেছিলেন, খেলায় হার-জিত থাকবে, কিন্তু তাঁরা খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামবেন না। নামবেন যোদ্ধা হিসেবে। কারণ, তাঁরা জীবনযোদ্ধা। তাঁদের কেউ খেলতে গেছেন মায়ের শেষ সম্বল বেচে। কেউ বোনের গয়না বিক্রি করে। কেউবা তাঁদের পরিবারের আয়ের একমাত্র অবলম্বন। কাজেই তাঁরা শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাবেন।
কিশোর আলোর জন্মদিন উদ্যাপন করব সানজিদাদের সঙ্গে। ১ অক্টোবর দুপুরে ওদের সঙ্গে মিলিয়ে দেব কলসিন্দুর প্রাথমিক আর উচ্চবিদ্যালয়ের ৪৫ জন মেয়েশিশু ফুটবলারদের। সানজিদা, সাজেদা, মারিয়া, দুই শামসুন, তহুরা, মার্জিয়া, শিউলি একবাক্যে রাজি। “কী আনব তোমাদের জন্য?” “কিছু না। আমাদের বাড়িতে আসবেন, আর বেশিক্ষণ থাকবেন।” এই হলো মেয়েদের আবদার।
সানজিদা তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর বাবা এলেন। ২০১৫ সালের পর থেকেই সানজিদার বাবার সঙ্গে আমার নিয়মিত কথা হয়। উপলক্ষ ছিল প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রামাণ্যচিত্র ‘অদম্য মেয়েরা’। ওই সময় আমরা লক্ষ করলাম, অনূর্ধ্ব–১৪ এএফসি কাপে পাকিস্তানকে ১৪ গোল দেওয়া বাংলাদেশ দলের ১০ সদস্য একটা স্কুল থেকে বেরোনো—কলসিন্দুর। কামরান পারভেজ প্রথম আলোয় প্রতিবেদন লিখলেন। রেদওয়ান রনি ‘অদম্য মেয়েরা’ বানালেন। হোটেল সোনারগাঁওয়ে সুধী সমাবেশে সেই প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হলো। কলসিন্দুরের ১৯ খেলোয়াড় মেয়ে আর মফিজ স্যারকে বরণ করে নেওয়া হলো। ২৫ খেলোয়াড়ের জন্য হলো প্রথম আলো ট্রাস্ট বৃত্তির ব্যবস্থাও।
আজ থেকে সাত বছর আগে প্রথম আলোর দেওয়া লাল জামা পরে সানজিদা মারিয়া তহুরা—এই বালিকারা অনুষ্ঠানস্থলে প্রজাপতির মতো ঘুরছিল। ওরা আমাকে ঘিরে ধরে বলেছিল, ‘আমাদের এলাকায় কারেন্ট নাই, আপনাদের সিনেমা দেখব কী করে?’ সেই কথা আমি লিখলাম। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানালেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে। এক মাসের মধ্যে ওই দুর্গম গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেল। তারপর থেকে কলসিন্দুর গ্রামের যেকোনো সমস্যায় এবং সাফল্যে আমি ফোন পাই। তখনকার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম আলোর এক শিক্ষার্থী সমাবেশে এসে সেই ভিডিও দেখলেন। কথা দিলেন কলসিন্দুর উচ্চবিদ্যালয় সরকারি হবে। তা–ও হলো। কলসিন্দুর স্কুল চত্বরে উঠল নতুন ভবন। অনূর্ধ্ব–১৪ মেয়েরা এএফসি কাপে চ্যাম্পিয়ন হলে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের ডেকে পাঠালেন। বললেন, তোমরা আমাকে নানু বা দাদু ডাকবে। ওদের আর্থিক উপহার দিলেন।
কলসিন্দুর একটা ছোট্ট অবহেলিত গ্রাম। ধোবাউড়া একটা ভুলে যাওয়া উপজেলা। শুধু ফুটবলার বালিকাদের জন্য পরিচিতি পেল। পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাংলাদেশি আছে, সেখানেই এখন পৌঁছে গেছে কলসিন্দুরের নাম। তা করেছেন এই সানজিদারা।
আমরা সানজিদার মায়ের সঙ্গে দেখা করলাম। হাতে উপহার গুঁজে দিলাম। ভাইবোনদের ডেকে আনলাম। বাড়ির উঠানে গিয়ে আগের কারুকার্যময় টিনের ঘরে ঢুকে পায়রার বাকবাকুম আর পাখা নেড়ে ওড়ার শব্দ শুনলাম।
সানজিদা কিন্তু ভীষণ চটপটে। তিনি বলে রেখেছিলেন, ‘আপনাকে মারিয়ার বাড়িতে নিয়ে যাব। কেন, সেটা গেলেই বুঝবেন।’
মারিয়ার বাড়ি নেতাই নদের অপর পারে। গাড়ি নিয়ে কিছুদূর গিয়েই গাড়ি ছেড়ে হাঁটা পথে আমরা চললাম নদীর ঘাটে। একটা নৌকা বাঁধা। সেই নৌকায় উঠে অপর পার পৌঁছানো সহজ নয়। তারপর কঠিন, খাড়া পাড়ে ওঠা। বালুর বস্তা ফেলা হয়েছে। কুড়ি ফুটের মতো ওপরে উঠতে হবে সাবধানে। মারিয়াও আমাদের সঙ্গে নৌকায়। মারিয়া আর সানজিদা বলতে লাগলেন, ‘এবার বুঝুন, একজন প্রেগন্যান্ট মহিলা এই ঘাটে নামবে কী করে? নৌকায় উঠবে কী করে? বর্ষায় এই নদী কূল ছাড়িয়ে যায়। নদীর ওই পারে হাজার হাজার মানুষ থাকে। এই নেতাই নদীতে সেতু চাই।’
খাড়া পাড় বেয়ে ওপরে উঠে দেখি শত শত মানুষ ভিড় করে আছেন। তাঁরা একযোগে বলে উঠলেন, ‘আমরা সেতু চাই।’ আমি বলি, ‘আপনাদের ফুটবলার মেয়েদের আপনারা ভালোবাসেন? হ্যাঁ। আমরা খুব গর্বিত।’ গ্রামবাসী সমস্বরে বলে উঠলেন। তাঁরা মারিয়ার জন্য এই পাড়ে তিনটা গেট বানিয়েছিলেন। গারো বাড়িটিতে আগের রাতে বেশ নাচগান হয়েছে। রঙিন ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে মারিয়ার বোনেরা নেচেছিলেন।
মারিয়ার মা গির্জা থেকে ফিরলেন। এনোতা মান্দা। মায়ের চেহারায় বিজয়িনীর প্রভা। বাড়ি সাজানো হয়েছে, দূরদূরান্ত থেকে স্বজনেরা এসেছেন। বাড়িতে বিয়েবাড়ির ফুর্তি।
মারিয়ার বাড়ি থেকে ফিরতেই ঘটল অবশ্যম্ভাবী অঘটন। আমাদের গাড়ির চাকা মাটিতে দেবে গেছে। কিছুতেই উঠছে না। ইজিবাইক আর মোটরবাইকে আমরা কলসিন্দুর স্কুলে ফিরলাম।
এরই মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী, সাবেক কোচ মফিজউদ্দীন এসে গেছেন। কলেজের সহকারী অধ্যাপক মালারানী ব্যস্ত। গামারীতলা ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন খান আমাদের আপ্যায়ন করবেন, বিকেলে তাঁর আয়োজিত সংবর্ধনাও আছে; তাঁর মোটরবাইকও এদিক–ওদিক ছুটছে। জাতীয় দলের আরও ছয় খেলোয়াড় এসে গেছেন। শিউলি, সাজেদা আমাকে বললেন, একটু কথা আছে। দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বললেন, আমাদের বাড়ির ধারে নদ এসে গেছে।
আমাদের বাড়ি আর মসজিদ, গির্জা যেকোনো সময় ভাঙনের মধ্যে পড়বে। সিমেন্টের ব্লক ফেলতে হবে। সাজেদা বললেন, বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটা ভাঙা। চেয়ারম্যান সাহেব জানালেন, টেন্ডার হয়েছে। ১০ ফুট রাস্তা। আমরা ১৬ ফুট চাচ্ছি। নেতাই নদের সেতু, নদে ভাঙনরোধী ব্লক এবং গামারীতলা ইউনিয়নের এই রাস্তাটার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এবার আমরা মিশে গেলাম ৪৫ জন নতুন খেলোয়াড়ের সঙ্গে। দেবদূতের মতো একেকটা শিশু। একজনের নাম হাসিনা। আমার কাছে লাগছে যেন পরি। ফুটবলের জার্সি পরে আছে। কিন্তু এরা এসেছে চাষি–শ্রমিক পরিবার থেকে। খেলবে যে খাবে কী? একটা বাচ্চা খেলার পর ক্লান্ত হয়ে কী খেয়ে ঘুমাবে? ২ অক্টোবর ২০২২ প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ‘অভিবাদন অপরাজিতা’য় সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের সাজেদা খাতুনের কথা পড়ুন, ‘ফুটবলে আসার পেছনে আরেকটা কারণ ছিল সাজেদার। বাড়িতে ঠিকমতো খেতে পারতেন না। কিন্তু অনুশীলনে গেলে পেট ভরে খাওয়া দিতেন মফিজ উদ্দীন, পেতেন সেদ্ধ ডিম ও কলা।’
বাচ্চাদের জন্য কিশোর আলোর পক্ষ থেকে আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম ব্যাকপ্যাক, জার্সি, মগ। সেসব দিলাম। কেক কাটা হলো। এমন সপ্রতিভ বাচ্চারা। আমি বলি, এসো স্লোগান ধরি, ‘তহুরা আপা তহুরা আপা’, ওরা জবাব দেয় ‘এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও’।
ওই কেক কেটে কেটে বাচ্চারা খাচ্ছিল। আমি এত তৃপ্তি করে কেক খেতে আর কাউকে কোনো দিন দেখিনি। এরপর ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার সাহেব সব শিশুকে নিয়ে আমাদের খাবার টেবিলে বসালেন।
খেলোয়াড়দের মায়েদের জন্য মিষ্টি আর কিছু উপহার নিয়ে গিয়েছিলাম। খেলোয়াড়েরা কিছু চায়নি। চেয়েছিলেন আমরা যেন বেশিক্ষণ থাকি। আমাদের গাড়ি উদ্ধার করতে ছয় ঘণ্টা লেগে যাওয়ায় তাঁদের সেই চাওয়া পূরণ হয়েছিল।
ইউনিয়ন পরিষদের দেওয়া সংবর্ধনায় মেয়েরা অংশ নিলেন। সন্ধ্যা নেমে আসছে। উদ্ধার পাওয়া গাড়ি এসে গেলে আমরা রওনা হলাম।
ঢাকায় নিজের বাসায় নামলাম রাত একটার পর। তা–ও সম্ভব হলো, যানজট কম ছিল বলে। টানা ২১ ঘণ্টা গাড়িতে বসে থেকে এবং রোদে রোদে ঘুরে ঘরে ফিরেও নিজেকে মোটেও ক্লান্ত বলে মনে হয়নি।
মারিয়া, সাজেদারা এই পথে বাড়ি ফেরে লোকাল বাসে চড়ে। প্রথমে ময়মনসিংহ। তারপর ধোবাউড়া। তারপর ইজিবাইকে বাড়ির পথে। তারপর হাঁটা। মারিয়ার বেলায় তারপর নৌকা...
মারিয়ারা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারশনের হোস্টেলে থাকেন। মতিঝিলে। মাসে মাসে বেতন পান। কত টাকা, জানেন? ১০ হাজার টাকা।
কলসিন্দুর একটা ছোট্ট গ্রাম। ফুটবল নিয়ে সেখানকার মেয়েশিশুরা যাবতীয় বৈষম্য, পশ্চাৎপদতা, আর নৈরাশ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের কোটি কোটি শিশু আলোর প্রদীপ হয়ে অন্ধকার তাড়াবে বলে আসছে।
‘স্যার। পৌঁছাইছেন?’ ইনবক্স ভরে যায় কুশলবার্তায়! জবাবে বারবার বলব, ধন্যবাদ, কলসিন্দুর, আমাদের আশা দেবার জন্য। আমরা যে স্বপ্ন দেখব বলে ওদের কাছে দুহাত পেতে রেখেছি।