টানা পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর দেশে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু হয়েছে। তবে শুরুতে সবাই ইন্টারনেট পাচ্ছেন না; জরুরি সেবা, আর্থিক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমসহ কিছু খাতকে প্রাধান্য দিয়ে ইন্টারনেট চালু হচ্ছে।
রাজধানীর বিটিআরসি ভবনে আজ মঙ্গলবার বিকেলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক সাংবাদিকদের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালুর বিষয়ে জানান।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আজ মঙ্গলবার রাতের মধ্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ চালু হবে। প্রাথমিকভাবে ব্যাংক, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যমের কার্যালয় ও কূটনৈতিক এলাকায় ইন্টারনেট চালু হবে। তথ্যপ্রযুক্তি খাত, রপ্তানিমুখী শিল্প খাত, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও হাসপাতালের মতো জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান, রেলওয়ে, প্রবাসীকল্যাণ সেবা এবং এয়ারলাইনস সেবা প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় থাকা এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যাবে। এরপর এলাকার পরিধি বাড়ানো হবে। খুব দ্রুত সার্বিকভাবে পুরো ইন্টারনেট সেবা চালু হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চালুর বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিষয়টি এখনো আমি নিশ্চিত বলতে পারছি না যে কতটুকু আমরা আসলে অ্যালাউ (অনুমোদন) করতে পারব। এ পর্যায়ে ইন্টারনেটকে আগে পুনঃস্থাপন করি। আগামীকাল (আজ বুধবার) বলি, পরের অবস্থান কী।’
কারও যদি অগ্রাধিকার এলাকার প্রস্তাব থাকে, তাহলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) জানালে এবং সেটা যৌক্তিক মনে হলে ইন্টারনেট দেওয়া হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ।
মোবাইল ইন্টারনেট এখনো বন্ধ রয়েছে। এটা চালুর বিষয়ে পরে জানানো হবে বলে উল্লেখ করেন প্রতিমন্ত্রী।
কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হলে ১৭ জুলাই (বুধবার) রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) রাত ৯টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ হিসেবে ১৮ জুলাই এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, জাতীয় ও নাগরিক নিরাপত্তার বিষয় মাথায় রেখে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় একদল তরুণ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছিলেন। আরেক অপারেটর রবির একটি গ্রাহক সেবা কেন্দ্র বা কাস্টমার কেয়ার সেন্টার ভাঙচুর করা হয়। তখন অপারেটরদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ইন্টারনেট চালুর ক্ষেত্রে সরকারের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা রয়েছে।
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধের ক্ষেত্রে সরকার ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত ডেটা সেন্টারে আগুন দেওয়ার বিষয়টি সামনে আনছিল। প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ আজ বলেন, সারা দেশে চারটি ডেটা সেন্টার এবং ৪০টির মতো সার্ভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে কয়েক শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ব্যাংক, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যমের কার্যালয় ও কূটনৈতিক এলাকায় ইন্টারনেট চালু অগ্রাধিকারভিত্তিতে।
পাঁচ দিন ইন্টারনেট না থাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল, অনলাইনে টাকা লেনদেন, মুঠোফোনে টাকা ভরা, অনলাইনে কেনাবেচা, ফ্রিল্যান্সিং, বিমানের টিকিট কেনা, অনলাইনভিত্তিক বিনোদনের মাধ্যম (ওটিটি, ইউটিউব প্রভৃতি) ও পড়াশোনা—সব সেবাই হয় বন্ধ রয়েছে কিংবা বিঘ্নিত হয়েছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাতে সমস্যায় পড়েছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) জানিয়েছে, ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকার কারণে পাঁচ দিনে সফটওয়্যার খাতের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০০ কোটি টাকার ওপরে।
সরকার ২২ জুলাই সোমবার দেশের আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইন্টারনেট সেবা চালুর ক্ষেত্রে সরকার ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপ বন্ধের কথা বলেছে। এসব সেবা বন্ধ রেখে ইন্টারনেট চালু করা সম্ভব কি না, সে বিষয়ে পরীক্ষা করে বিটিআরসিকে জানাতে বলা হয়েছিল। সূত্র জানায়, কিছু ক্ষেত্রে এসব সেবা বন্ধ করা হলেও সব ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান, রেলওয়ে, প্রবাসীকল্যাণ ও এয়ারলাইনস সেবা প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় থাকা এলাকায়ও পাচ্ছে প্রাধান্য।
এরপর আজ রাতে সীমিত পর্যায়ে ইন্টারনেট চালু করা হলো। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এর আগেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করেছিল। কতটা সফল হয়েছিল, সেটি সবাই জানেন। তবে টানা পাঁচ দিন ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে, তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। আইসিটি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবার বিষয়টি এখন বিবেচনায় আসবে। অনেক ব্যবসায়ী গ্রাহকের আস্থা হারাবেন।
মহাখালীতে ডেটা সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে বি এম মইনুল বলেন, দেশের ইন্টারনেট অবকাঠামো একটি জায়গাকেন্দ্রিক কেন হবে এবং কেন এর বিকল্প ব্যবস্থা থাকবে না।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ইন্টারনেট বন্ধের ক্ষেত্রে মহাখালীতে ক্ষয়ক্ষতির যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তা সঠিক নয়। কারণ গত বছর মহাখালীর খাজা টাওয়ার পুড়ে যাওয়ার পরও দেশজুড়ে ইন্টারনেট সচল ছিল। যদিও কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছে। খাজা টাওয়ার স্থাপনা থেকে দেশজুড়ে মোট চাহিদার ২০ শতাংশের মতো ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করা হয়।