মশা মারার মূল দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। মশা মরার জন্য নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো এই মন্ত্রণালয় ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে না। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যেসব পরামর্শ দিয়েছিল, সেগুলোরও বাস্তবায়ন হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দায়িত্বশীলদের আন্তরিকতার অভাবেই ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
দুই দশকের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হওয়া শুরু করলেই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। সভা-সেমিনার হয়, বিশেষজ্ঞদের ডাকা হয়। কিছু সিদ্ধান্ত হয়। হয়েছিল গত বছরও।
গত বছরের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সভার কার্যবিবরণীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলা আছে। প্রশ্ন উঠছে, সিদ্ধান্তগুলো কি বাস্তবায়িত হয়নি? যদি হয়েই থাকে, তা হলে এ বছর এত মানুষ কেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, কেন ডেঙ্গুতে এত মানুষ মারা যাচ্ছেন?
দেশে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে ২০২২ সালের ১৯ জুন স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলনকক্ষে সিটি করপোরেশন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। সভায় ১০টি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং কোন মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা অধিদপ্তর একক বা যৌথভাবে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে, তা ঠিক করা হয়।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে থাকলে গত বছর ডেঙ্গুতে ৬২ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হতেন না। এ বছরও মশা নিয়ন্ত্রণে নেই।কবিরুল বাশার, কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
১ মাস ১০ দিন পর ২০২২ সালের ২৮ জুলাই একই স্থানে একই বিষয়ে পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতেও সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। ওই সভায় নয়টি সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ছাড়াও সভাগুলোতে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজসহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞরা।
সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সন্তুষ্ট। তবে একাধিক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রথম সভার কার্যবিবরণী থেকে বক্তব্য হুবহু দ্বিতীয় সভার কার্যবিবরণীতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
১৯ জুনের সভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছিলেন, সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য সংস্থা তাদের সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সফলতার সঙ্গে ভূমিকা পালন করছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রীর নির্দেশনা, নিবিড় তদারকি এবং সঠিক কর্মপরিকল্পনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মশক সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজ বলেছিলেন, মন্ত্রীর সফল নেতৃত্বে ও সিটি করপোরেশনের সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করার ফলে সফলভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে।
২৮ জুলাইয়ের সভায় একইভাবে সফলতার কথা বলা হয়। তার পর থেকে ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়তে দেখা যায়।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে থাকলে গত বছর ডেঙ্গুতে ৬২ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হতেন না। এ বছরও মশা নিয়ন্ত্রণে নেই। নিয়ন্ত্রণে থাকলে ইতিমধ্যে ৬০ হাজারের মতো মানুষ আক্রান্ত হতেন না।’
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দুটো সভাতেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০টি উপ-অঞ্চলে ভাগ করতে হবে এবং প্রতিটিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে কমিটি গঠন করতে হবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দুটো সভাতেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০টি উপ-অঞ্চলে ভাগ করতে হবে এবং প্রতিটিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে কমিটি গঠন করতে হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে তিন স্তরবিশিষ্ট কমিটি করা হয়েছে। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এমন কোনো কমিটি হয়নি। অন্য ১০টি সিটি করপোরেশনেও এ ধরনের কোনো কমিটি গঠিত হয়নি।
বৃহস্পতিবার উত্তর সিটি করপোরেশনের অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর প্রতিনিধি জানতে চান ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু বা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যক্রম আদৌ আছে কি না, সেটার দায়িত্ব কার?—জবাবে মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এডিস মশা সারা দেশে বিস্তার লাভ করতে পারে, এ রকম একটা আশঙ্কা থেকেই আমরা ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন তৈরি করেছি মন্ত্রণালয় থেকে। স্থানীয় সরকারের যতগুলো প্রতিষ্ঠান আছে—ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনসহ সব প্রতিষ্ঠানকে তাদের দায়িত্ব বিভাজন করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা যেন দায়িত্ব পালন করে।’
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। নারায়ণগঞ্জ ও রংপুর সিটি করপোরেশনে একজন করে কীটতত্ত্ববিদ আছেন। দেশের বাকি আট সিটি করপোরেশনে অর্থাৎ খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, গাজীপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই।
সভার একটি সিদ্ধান্ত ছিল সিটি করপোরেশনগুলোর চাহিদামতো কীটতত্ত্ববিদ পদায়ন করতে হবে।
মশা নিয়ন্ত্রণে কীটতত্ত্ববিদদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কীটতত্ত্ববিদেরা বলতে পারেন মশার প্রজনন স্থান কোনটি, তাঁরা জরিপ করে বলতে পারেন কোথায় মশা বেশি, কোথায় কম।
সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বহু বছর ধরে বলে আসছি। কাজ হচ্ছে না। সাধারণ মশকনিধনকর্মী দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। নারায়ণগঞ্জ ও রংপুর সিটি করপোরেশনে একজন করে কীটতত্ত্ববিদ আছেন। দেশের বাকি আট সিটি করপোরেশনে অর্থাৎ খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, গাজীপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই।
কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে। এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে অনুষ্ঠিত এক সভায় মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ১০ জন কীটতত্ত্ববিদ দেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেন।
জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য নির্মাণাধীন স্থাপনার সামনে মশার উৎসস্থল ধ্বংসের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাসহ সাইনবোর্ড লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এই সাইনবোর্ড লাগানোর দায়িত্ব ছিল সব সিটি করপোরেশন ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের।
ঢাকা শহরে একাধিক বড় প্রকল্প ছাড়াও বহু জায়গায় নির্মাণাধীন স্থাপনা আছে। কিন্তু কোথাও ওই ধরনের কোনো সাইনবোর্ড চোখে পড়ে না।
এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে ২০১৭ সালে মধ্যবর্তী পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক কে কে কৃষ্ণমূর্তি। তাতে মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পদ্ধতি কী হবে এবং রোগ ব্যবস্থাপনায় কী করতে হবে, তার বিশদ বর্ণনা ছিল। অভিযোগ আছে, সেই পরিকল্পনামতো কাজ করা তো দূরের কথা, গত পাঁচ বছরে স্বাস্থ্য বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কোনো সভায় তা নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি।
২০১৯ সালে দেশে ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ববিদ বি এন নাগপাল ঢাকায় এসেছিলেন করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য। এডিস মশার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য নিয়ে একাধিক অনুষ্ঠানে তিনি বিশদ বর্ণনা করেছিলেন, পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এডিস মশা কখনোই ড্রেনে ডিম পাড়ে না। এরা বিশ্রাম নেয় টেবিলের নিচে, সোফার নিচে, বিছানের নিচে, চেয়ারের নিচে, পর্দার পেছনে, আলমারির পেছনে— যেখানে অন্ধকার থাকে। তিনি আরও বলেছিলেন, সিটি করপোরেশনের সীমিতসংখ্যক কর্মী প্রতিটি বাড়িতে বা অফিসে গিয়ে মশার উৎসস্থল চিহ্নিত করতে পারবে না, মশার ডিম পাড়া বন্ধ করতে পারবে না। এ জন্য মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সেসব পরামর্শ মানা হয়নি।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু এখন সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। এখন কারিগরিভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে গুরুত্ব দিতে হবে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত না হলে দায়িত্বপ্রাপ্তদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ও সংকট দীর্ঘতর হওয়ার আশঙ্কা আছে।